সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার একটি বিশ্বনন্দিত পুরস্কার। যা প্রতি বছর এক বা একাধিক লেখক তথা সাহিত্যিককে দেওয়া হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন হাঙ্গেরীয় লেখক লাসলো ক্রাসনাহরকাই। ৯ অক্টোবর তার নাম ঘোষণা করে সুইডিশ অ্যাকাডেমি।
সুইডিশ অ্যাকাডেমি বলেছে, ‘তিনি এই পুরস্কার পেয়েছেন তার চিত্তাকর্ষক ও দূরদর্শী সৃজনকর্মের জন্য। যা মহাপ্রলয়ের ভয়াবহতার মধ্যেও শিল্পের শক্তিকে পুনর্জীবিত করে। তিনি মধ্য ইউরোপীয় সাহিত্যের একজন মহাকাব্যিক লেখক। তার রচনা ফ্রাঞ্জ কাফকা এবং টমাস বার্নহার্ডের রচনার সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে।’ তিনি জার্মানির পটভূমিকায় লেখা ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ বইয়ের জন্য এ পুরস্কার লাভ করেন।
লেখক লাসলো ক্রাসনাহরকাই ১৯৫৪ সালে রোমানিয়ান সীমান্তের কাছে দক্ষিণ-পূর্ব হাঙ্গেরির ছোট শহর গিউলায় জন্মগ্রহণ করেন। একই রকম প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকা তার প্রথম উপন্যাস ‘সাটানটাঙ্গো’র পটভূমি। যা ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। উপন্যাসটি হাঙ্গেরির সাহিত্য মহলে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল। ফলে এটিকে লেখকের যুগান্তকারী রচনা হিসেবে গণ্য করা হয়।উপন্যাসে শক্তিশালী ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষায় কমিউনিজমের পতনের ঠিক আগে হাঙ্গেরিয়ান গ্রামাঞ্চলে পরিত্যক্ত যৌথ খামারে বসবাসকারী এক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চিত্র তুলে ধরা হয়। কাহিনিতে নীরবতা এবং প্রত্যাশার রাজত্ব বিরাজ করছিল। উপন্যাসের দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ইরিমিয়াস এবং তার বন্ধু পেট্রিনা। যাদের সবাই মৃত বলে বিশ্বাস করতো। কিন্তু হঠাৎ করেই তারা একদিন উপস্থিত হন।
ফলে সেখানে অপেক্ষারত বাসিন্দাদের কাছে তাদের দুজনকে আশার বার্তাবাহক বা শেষ বিচারের বার্তাবাহক বলে মনে হয়। বইয়ের কাহিনিতে এ বিষয়ে প্রতারণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা প্রতারক ইরিমিয়াসের মধ্যে নানা রকম ভান বা ছলচাতুরি লক্ষ্য করা যায়। ফলে তাদের প্রতারণার কাছে সবাই বন্দি হয়ে পড়ে।
যে কারণে উপন্যাসের প্রত্যেকেই একটি অলৌকিক ঘটনার জন্য অপেক্ষা করেন। সবার মনেই একটি আশা জন্ম নেয়, ‘আমি এটির জন্য অপেক্ষা করবো, না হলে জিনিসটি মিস করবো।’ বিখ্যাত এই উপন্যাসটি পরিচালক বেলা টারের সহযোগিতায় ১৯৯৪ সালে চলচ্চিত্রে পরিণত হয়েছিল।
আমেরিকান সমালোচক সুসান সনট্যাগ সমসাময়িক সাহিত্যের ‘মহাপ্রলয়ের গুরু’ হিসেবে ভূষিত করেন লাসলো ক্রাসনাহরকাইকে। লেখকের দ্বিতীয় বই ‘অ্যাজ এলেনাল্লাস মেলানকোলিয়াজা’ (১৯৮৯); যার ইংরেজি অনুবাদ ‘দ্য মেলানকলি অব রেজিস্ট্যান্স’ (১৯৯৮) পড়ার পর তিনি এ সিদ্ধান্তে আসেন। এ উপন্যাসে কার্পেথিয়ান উপত্যকায় অবস্থিত হাঙ্গেরির একটি ছোট শহরে চিত্রিত ভয়ানক কল্পকাহিনিতে নাটকীয়তা বেড়ে ওঠে।
তবে তার অপর উপন্যাস ‘হাবারু এস হাবারু’ (১৯৯৯); ইংরেজি অনুবাদ ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ারে’ (২০০৬) লেখক মনোযোগ হাঙ্গেরির সীমানা থেকে বাইরে সরিয়ে নেন। তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ২০০৩ সালের উপন্যাস ‘এ মাউন্টেন টু দ্য নর্থ, এ লেক টু দ্য সাউথ, পাথস টু দ্য ওয়েস্ট, এ রিভার টু দ্য ইস্ট’। উপন্যাসটি জাপানের কিয়োটোর রহস্যময় কাহিনিকে কাব্যিক সৌন্দর্যে তুলে ধরেছে। যেখানে সেইবো নামের এক দেবী এমন একটি বাগান পাহারা দেন; যেখানে প্রতি তিন হাজার বছর পর অমরত্বের ফল ধরে।
উপন্যাসটির ওপর ভিত্তি করে তিনি সাহিত্য সংকলন ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ রচনা করেন। এতে ১৭টি গল্প আছে, যা বিশেষভাবে সাজানো। গল্পসমূহে এমন এক জগতের সৌন্দর্য ও শিল্প নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে; যে জগৎ দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং যার সৌন্দর্য উপলব্ধি করা কঠিন। গল্পের সূচনা হয় কামো নদীর তীরে অপেক্ষারত বকের মুগ্ধকর চিত্র দিয়ে। তার মানে, গল্পগুলো শিল্প সৃষ্টির প্রক্রিয়া নিয়ে অনুসন্ধান করে। তাতে দেখানো হয় শিল্প সৃষ্টি হয় দীর্ঘ প্রস্তুতি ও নিপুণ দক্ষতার মধ্যদিয়ে। কখনো আবার অপ্রত্যাশিত ঘটনা সৃষ্টিকে প্রভাবিত করে।জার্মানির বার্লিনে বেশ কয়েক বছর বসবাস করেন এই লেখক। তিনি বার্লিনের ফ্রি ইউনিভার্সিটিতে ছয় মাস অতিথি অধ্যাপক ছিলেন। বর্তমানে হাঙ্গেরির একটি পাহাড়ে নির্জনে বসবাস করছেন। ১৯৯০ সালে তার প্রথম স্ত্রী আনিকো পেলিহের সাথে বিবাহবিচ্ছেদ হয়। ১৯৯৭ সালে ডোরা কোপসানিকে বিয়ে করেন। যিনি একজন সাইনোলজিস্ট এবং গ্রাফিক ডিজাইনার। তার তিনটি সন্তান- কাটা, অ্যাগনেস এবং পান্নি। তিনি ২০১৫ সালে ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার এবং ২০১৯ সালে ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড ফর ট্রান্সলেটেড লিটারেচার জেতেন।