১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ  । ১লা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ 

সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা

২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল দেশের শিক্ষা পরিস্থিতির এক গভীর সংকটের প্রতিফলন। এ বছর পাসের হার নেমে এসেছে ৫৮.৮৩ শতাংশে। গত ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীও কমেছে প্রায় ৭৭ হাজার।সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজনও পাস করেনি। এই পরিসংখ্যান শুধু পরীক্ষার ফল নয়, বরং সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার রোগের লক্ষণ, যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাঙ্গনের সার্বিক পরিস্থিতির এক অশনিসংকেত।প্রতিবেদন থেকে এটি স্পষ্ট যে বছরজুড়ে শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতাই এই ফল বিপর্যয়ের প্রধান কারণ। শিক্ষার্থী, শিক্ষক উভয়ের আন্দোলন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের লাঞ্ছনা ও অপসারণের ঘটনা স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে।একটি স্বাভাবিক, স্থিতিশীল পরিবেশ ছাড়া শিক্ষার্থীরা কিভাবে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবে? শিক্ষাবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধূরী যেমনটা বলেছেন, ‘গত বছরজুড়ে শিক্ষাঙ্গনে যে অস্থিরতা ছিল, এর প্রভাব অবশ্যই ফলাফলে পড়েছে।’
ফল বিশ্লেষণে আরো জানা যায়, এবার খাতা দেখায় ‘সহানুভূতি নম্বর’ দেওয়া হয়নি, যা সঠিক মূল্যায়নের দিকে ইঙ্গিত করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশীদ মনে করেন, শিক্ষার্থীরা যেটি ডিজার্ভ করে, তাদের সেটিই দেওয়া উচিত। তবে শুধু মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তনকেই একমাত্র কারণ হিসেবে দেখা যায় না।কারণ পাঁচ লাখের বেশি শিক্ষার্থীর অকৃতকার্য হওয়া কেবল কঠোর মূল্যায়নের ফল হতে পারে না।
ফল বিপর্যয়ের পেছনে শিক্ষকের অভাব, তাঁদের ন্যায্য দাবি আদায়ে আন্দোলন এবং দীর্ঘদিনের শেখার ঘাটতিও বড় ভূমিকা রেখেছে। ইংরেজি ও তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের খারাপ ফল এই ঘাটতিরই বহিঃপ্রকাশ। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরার এই ফলকে ব্যর্থতা হিসেবে না দেখে আত্মসমালোচনার সুযোগ হিসেবে দেখছেন এবং শেখার প্রকৃত সংকট চিহ্নিত করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন।এই বছর ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজনও পাস করেনি, যা গত বছর ছিল ৬৫টি।
শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও এক হাজার ৩৩৮ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪৫-এ। এই পরিসংখ্যান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর গুণগত মান এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের গভীর অবনতির চিত্র তুলে ধরে।
এই ফল বিপর্যয় কোনো একক পক্ষের দায় নয়, এটি সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা। সরকার, শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও অভিভাবক—সবারই আত্মসমালোচনা এবং সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি। এটি আমাদের শিক্ষাকাঠামোর অন্তর্নিহিত দুর্বলতার প্রতিফলন। আমরা মনে করি, এই ফলাফলকে ব্যর্থতা নয়, আত্মসমালোচনার উপাদান হিসেবে গ্রহণ করা উচিত, যেমনটি শিক্ষা উপদেষ্টাও বলেছেন। শেখার প্রকৃত মানোন্নয়ন ও শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন ছাড়া আগামী বছরগুলোতেও ‘ফল বিপর্যয়’ শব্দবন্ধটি আমাদের পিছু ছাড়বে না।

 

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়