প্রতিদিনের ডেস্ক:
হৃদরোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে ১৯৭৮ সালে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে প্রতিষ্ঠা করা হয় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। হৃদরোগীদের জন্য এটি দেশের সবচেয়ে বড় ও একমাত্র সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতাল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হৃদরোগীদের ভিড় লেগেই থাকে হাসপাতালটিতে। এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অধিকাংশই স্বল্প ও নিম্নআয়ের মানুষ। কিন্তু হাসপাতাল ঘিরে দালাল চক্র ও চোরের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ায় নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনদের। ভোগান্তি থেকে রেহাই মিলছে না চিকিৎসক-কর্মকর্তাদেরও।হাসপাতালে দালালের দৌরাত্ম্য চরমে ‘এই টিকিটে ইন্টার্ন (শিক্ষানবিশ) ডাক্তার দেখাবেন। অথচ, আমার সঙ্গে আসেন, আমি ফ্রিতে অধ্যাপক দেখিয়ে দেব।’— হৃদরোগ হাসপাতালের বহির্বিভাগের টিকিট কাটার পর কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে এক নারী (দালাল) এভাবেই এক রোগীকে বোঝাচ্ছিলেন।সেবা নিতে আসা রোগীদের বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে অন্যত্র ভাগিয়ে নেওয়ার এ চিত্র অহরহ ঘটে হৃদরোগ হাসপাতালে। হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে টিকিট কাটার পরই রোগীদের পিছু নেন দালালরা। নানা প্রলোভনে তারা রোগীদের বাইরের হাসপাতালে নিয়ে যান।এমন চিত্র দেখে কয়েকজন রোগী ও তাদের স্বজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন জাগো নিউজের এই প্রতিবেদক। বিষয়টি আঁচ করে এবার পাঁচ-সাতজন মিলে প্রতিবেদককে ঘিরে ধরেন। ‘আপনি কে? কেন এখানে এসেছেন? রোগীদের সঙ্গে কথা বলে আমাদের কাজে ব্যাঘাত করছেন কেন?’— এমন সব প্রশ্ন করতে করতে তারা রীতিমতো হামলে পড়ে।রাশেদ নামের একজন জানান, তিনি অ্যাডভান্স ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মী। এখান থেকে কথা বলে রোগী নেন।রিপন ও আউয়াল নামের আরও দুজন জানান, তারাও রোগীদের এখান (হৃদরোগ হাসপাতাল) থেকে নিয়ে অন্য জায়গায় কম খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তবে রোগীদের সঙ্গে কথা বলেই তারা অন্য জায়গায় নেন। কাউকে জোর করেন না বলে দাবি করেন তারা। বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনের চালানো অভিযান ও অনুসন্ধানে উঠে এসেছে—প্রাইম হাসপাতাল, পিপলস, ঐতিহ্য, অ্যাডভান্স, আধুনিক, সন্ধি এবং ভায়টাল হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে আসা দালালরা প্রতিনিয়ত ভিড় জমান হৃদরোগ হাসপাতালে। বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে রোগীদের নিয়ে যান নিজেদের ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে আদায় করেন মোটা অঙ্কের টাকা।‘আপনার ডাক্তারের নাম কী?’—এমন প্রশ্নের জবাবে রিপন বলেন, ‘ডা. আজিজুল। জেনিক নামের একটি প্রতিষ্ঠানে বসেন। সেখানে উনি একাই বসেন। সরকারিভাবে দেখেন, কোনো ভিজিট নাই।’হাসপাতালে বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনের চালানো অভিযান ও অনুসন্ধানে উঠে এসেছে—প্রাইম হাসপাতাল, পিপলস, ঐতিহ্য, অ্যাডভান্স, আধুনিক, সন্ধি এবং ভায়টাল হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে আসা দালালরা প্রতিনিয়ত ভিড় জমান হৃদরোগ হাসপাতালে। বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে রোগীদের নিয়ে যান নিজেদের ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে আদায় করেন মোটা অঙ্কের টাকা।চোরের উপদ্রবে অতিষ্ঠ শুধু দালাল নয়, চোরের উপদ্রবেও অতিষ্ঠ হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল প্রশাসন। সম্প্রতি (১১ অক্টোবর রাতে) হাসপাতালের ক্যাথ ল্যাবের চারটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের তামার তার কেটে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এর ফলে পর দিন ল্যাবের কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে। এমন চুরির ঘটনা প্রায়শই ঘটে। অনেক সময় চিকিৎসক ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের জিনিসপত্রও খোয়া যাচ্ছে।এদিকে, চুরির ধারাবাহিক ঘটনায় গত ১৩ সেপ্টেম্বর হৃদরোগ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী র্যাব-২-এর অধিনায়ককে একটি চিঠি দেন। সেই চিঠিতে তিনি লেখেন, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল নিরলস চিকিৎসা সেবা দেওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের আপামর জনসাধারণের আস্থা অর্জনে সমর্থ হয়েছে। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের যেকোনো প্রান্তের নিরীহ সাধারণ মানুষ হৃদরোগের সমস্যায় পড়লেই সর্বপ্রথম এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে। এর পাশাপাশি শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত মানুষও এখানে চিকিৎসা নিতে আসে। এখানে চিকিৎসা নিতে আসা হৃদরোগীদের মধ্যে অধিকাংশই স্বল্প ও নিম্নআয়ের মানুষ। কিন্তু চিকিৎসা নিতে এসে দালাল ও চোরের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন তারা। হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগে চোর ও দালাল চক্র দমনে আপনার (র্যাব-২ এর অধিনায়ক) সহযোগিতা প্রয়োজন।যা বলছে হাসপাতাল প্রশাসনদালালের দৌরাত্ম্যের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী সহকারী পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। ‘প্রতিদিন কমবেশি এমন অভিযোগ শুনি। সকালে আমি আসার সময় খেয়াল করি—আমাকে দেখলে সবাই (দালাল) পালায়। আবার যেই সেই। বিভিন্ন কৌশলে চেষ্টা করছি এগুলো বন্ধ করতে। আমাদের অভ্যন্তরীণ নানা ব্যবস্থার পাশাপাশি থানায় অভিযোগ করেছি। র্যাব ও সেনাবাহিনীকে অফিসিয়ালি (আনুষ্ঠানিকভাবে) জানিয়েছি।’ —
পরে এ বিষয়ে কথা হলে হাসপাতালটির সহকারী পরিচালক ডা. মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, “কিছুদিন আগে এক রোগী আমার কাছে আসেন। তাকে ‘ফ্রি দেখিয়ে দেবে’ বলে নিয়ে গিয়ে টেস্ট দিয়ে তিন হাজার টাকা বিল নিয়েছে। গরিব রোগী, তিন হাজার টাকা নিয়েই ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি চান, আমি যেন টাকা তুলে দেই। কিন্তু আমি কীভাবে টাকা তুলে দেব?”ডা. মেজবাহ আরও বলেন, প্রতিদিন কমবেশি এমন অভিযোগ শুনি। সকালে আমি আসার সময় খেয়াল করি—আমাকে দেখলে সবাই পালায়। আবার যেই সেই। বিভিন্ন কৌশলে চেষ্টা করছি এগুলো বন্ধ করতে। আমাদের অভ্যন্তরীণ নানা ব্যবস্থার পাশাপাশি থানায় অভিযোগ করেছি। র্যাব ও সেনাবাহিনীকে অফিসিয়ালি (আনুষ্ঠানিকভাবে) জানিয়েছি।সঙ্গে পরিচয়পত্র রাখার নির্দেশ কর্মীদের দালাল ঠেকাতে হাসপাতালে অবস্থানের সময়ে সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখার নির্দেশ দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গত ৬ অক্টোবর এক অফিস আদেশে এই নির্দেশ দেওয়া হয়। অফিস আদেশে বলা হয়, যাদের ইউনিফর্ম বা নির্ধারিত পোশাক রয়েছে, তাদের পোশাকের ওপর দৃশ্যমানভাবে পরিচয়পত্র পরিধান করতে হবে।দালাল-চোরের দৌরাত্ম্য কমাতে হাসপাতালের প্রবেশদ্বারে নিরাপত্তা চৌকি স্থাপন এবং প্রবেশ পাস ছাড়া কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে না দেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

