১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ  । ১লা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ 

নতুন ধরনের বাজি ফাটিয়ে অন্ধ বহু শিশু-কিশোর

প্রতিদিনের ডেস্ক
হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব দীপাবলি। ভারতে প্রতি দীপাবলিতে ঝলমলে বাজি ফাটানোর নতুন ট্রেন্ড আসে, কিন্তু এবারের উন্মাদনা মারাত্মক হয়ে উঠেছে। নতুন ধরনের জনপ্রিয় এক বাজি ফাটিয়ে চোখ হারিয়েছে বহু শিশু-কিশোর। ‘কার্বাইড গান’ নামের এই নতুন বাজিটির কথা আগে কখনো শোনা যায়নি। ‘কার্বাইড বন্দুক’ বা ‘দেশি আতশবাজি বন্দুক’ ভারতে বাবা-মা এবং ডাক্তারদের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছে। দীপাবলির কিছুদিন আগে থেকে সামাজিক মাধ্যমে ঘরে তৈরি এই বাজির ভিডিও সামনে আসে। এসব ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই উত্তর ভারতে ব্যাপকভাবে বিক্রি হতে থাকে এই কার্বাইড গান। এই বাজি তৈরির সময় সাধারণ প্লাস্টিকের পাইপের ভেতরে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ভরে দেওয়া হয় এই বন্দুকে। ফাটালে গুলির আওয়াজের মতো শব্দ হয় এবং আলোর ঝলকানি দেখা দেয়। তবে ফাটার কোনো সময় নেই। অনেক সময়ে দেরিতেও ফাটছে। কেন বাজি ফাটছে না, সেটা দেখতে গিয়ে যখন শিশুরা পাইপের ভেতরে উঁকি দিচ্ছে, তখনই হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে কর্মকর্তারা বিবিসিকে জানিয়েছেন। পাটনার হাসপাতালের চিকিৎসক ড. সিনহা বিবিসিকে বলছিলেন যে, তার কাছে আসা এক রোগী ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। সামাজিক মাধ্যমে ওই ভিডিওগুলো দেখে সে নিজেই বাড়িতে ‘কার্বাইড গান’ বানিয়েছিল। বিস্ফোরণে তার একটি চোখের দৃষ্টি চলে গেছে। মধ্য প্রদেশের শুধু ভোপাল জেলাতেই ‘কার্বাইড গান’ ফেটে একশরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্তত ১৫ জনের চোখে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। অন্য তিন জেলা থেকেও একশর বেশি ঘটনা সামনে এসেছে। বিহারের রাজধানী পাটনার রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব অপথালমোলজির প্রধান ড. বিভূতি প্রসন্ন সিনহা জানিয়েছেন, ‘বিহারেও একই ধরনের বিস্ফোরণে ১৭০ জন আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৪০ জনের চোখে অপারেশন করতে হয়েছে।’ তবে তিনি বলছেন, অনেক ঘটনা অজানা থাকায় আহতদের সংখ্যা সম্ভবত আরো বেশি। ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড আর উত্তর প্রদেশ ছাড়া ভারতের রাজধানী দিল্লিতেও একই ধরনের বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। মধ্য প্রদেশের মতো কয়েকটি রাজ্য ‘কার্বাইড গান’ বাজি হিসেবে ব্যবহারের ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এ ছাড়া কয়েকজন বিক্রেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভোপালের হামিদিয়া হাসপাতালের চক্ষুরোগ বিভাগের প্রধান কভিথা কুমার বলেন, তাদের কাছে যেসব রোগী আসছেন, তাদের মধ্যে হালকা, মাঝারি আর ব্যাপক আঘাত পেয়েছেন চোখে। তিনি আরো বলেন, ‘যারা কম আঘাত পেয়েছেন, তাদের চোখের পাতায় রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়ে হালকা জ্বলে গেছে। মাঝারি ধরনের আঘাত প্রাপ্তদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, রাসায়নিক কণা কর্নিয়াতে ঢুকে গিয়ে মাঝারি ধরনের ক্ষত সৃষ্টি করেছে। যাদের বেশি আঘাত, তাদের কর্নিয়া ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সাময়িকভাবে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়েছে। অপারেশন করলে এ ধরনের রোগীদের দৃষ্টিশক্তি ফিরতেও পারে, তবে তাতে সময় লাগবে।’ হামিদিয়া হাসপাতালেরই চিকিৎসক ড. অদিতি দুবে জানাচ্ছিলেন, দীপাবলির বাজি ফেটে রাসায়নিক আঘাত হয়েছে, এমনটা ঘটনা তিনি আগে কখনো দেখেননি। ক্যালসিয়াম কার্বাইড কেনা-বেচা ভারতে নিয়ন্ত্রিত, কিন্তু কৃষক আর দোকানদারেরা অনেক সময়েই কৃত্রিমভাবে ফল পাকানোর জন্য এই রাসায়নিক ব্যবহার করে থাকেন। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, চাষের খেত থেকে জন্তু-জানোয়ারদের ভয় দেখিয়ে তাড়ানোর জন্যও এ ধরনের ঘরোয়া তৈরি বন্দুক ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে গত সপ্তাহে এত বেশি সংখ্যায় আহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হওয়ার আগে পর্যন্তও ভারতের বেশির ভাগ মানুষই এই ঘরোয়া বন্দুকের নামও শোনেননি। ‘কার্বাইড গান’ দিয়ে ইন্টারনেটে সার্চ করে ইনস্টাগ্রাম আর ইউটিউবে কয়েক ডজন ভিডিও পাওয়া গেছে, যেখানে অল্পবয়সীরা এই বাজি নিজেরাই বানিয়ে তারপরে তা ফাটিয়েও দেখাচ্ছেন। ওইসব ভিডিওর পেছনে কখনও আবার র‍্যাপ সংগীত যোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এসব ভিডিও যারা বানিয়েছেন, তাদের কেউ এগুলোর নাম দিয়েছেন ‘বিজ্ঞানের পরীক্ষা’, কোনওটিতে হ্যাশট্যাগ দেওয়া হয়েছে ‘ইউজফুল প্রজেক্ট’ বা ‘এক্সপেরিমেন্ট ভিডিও’। অনেক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, ইনস্টাগ্রাম রিলস এবং ইউটিউবের ভিডিও দেখে তারা কার্বাইড গান কিনেছিলেন। এই ঘরোয়া বাজি কেনার পেছনে অন্যতম আকর্ষণ দাম। বেশি শব্দ আর আলোর ঝলকানি হবে অথচ দামও তুলনামূলকভাবে সস্তা। মাত্র দেড়শো থেকে দুইশত রূপি। অল ইন্ডিয়া অপথালমোলজিকাল সোসাইটির সভাপতি ড. পার্থ বিশ্বাস বলছেন, ‘কার্বাইড গান’ অতি দ্রুত নিষিদ্ধ করা হোক। তার কথায়, ‘এটা একটা জাতীয় স্তরের সমস্যা হয়ে উঠেছে।’ তিনি আরো বলেন, ভারত ক্রিকেট ম্যাচ জিতলে বা নববর্ষের মতো উৎসবের সময়েও এই ঘরোয়া যন্ত্র ভবিষ্যতে বাজি হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে। ড. পার্থ বিশ্বাস বলেন, ‘ঘরোয়াভাবে তৈরি এই ‘কার্বাইড গান’ স্থায়ীভাবে অন্ধ করে দিতে পারে। এমনকি শরীরের অন্য অংশও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, পঙ্গুও হয়ে যেতে পারেন কেউ।’ এসব যন্ত্র যারা বানাচ্ছে, তাদের ধরপাকড়ের জন্য দেশব্যাপী অভিযান যেমন চালানো উচিত। পাশাপাশি ক্যালসিয়াম কার্বাইডের উৎপাদন ও বিক্রির ওপরও কঠোর নিয়ন্ত্রণের দাবি জানিয়েছেন তিনি।-সূত্র : বিবিসি

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়