সুন্দর সাহা
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি…’। শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি সম্মান জানাবে রক্তঋণে বাঁধা জাতি। । সবার হাতে হাতে থাকবে ফুল। কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে অমর এই গান। ‘কালো রাজপথ যেন মনে হয়/ হাজার হাজার পলাশ হয়ে চেয়ে রয়/ সে কোন জাদুকর পথের উপর ফুটিয়েছে রক্ত পলাশ’। এই গানের প্রতিটি ছত্রে বাঙালির বুকের গভীরে অনুরণিত হয় বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির সেই ‘ভাই হারানোর জ্বালা’। তীব্র বেদনা ও আত্মত্যাগের অহংকারের সঙ্গে ভাষার গৌরব সুপ্রতিষ্ঠিত করার অনন্য এক দিন আজ। রক্ত-পলাশের ফাগুনের এমনই এক আগুন-ঝরা দিনে মায়ের ভাষায় কথা বলার দাবিতে রাজপথ রাঙানোর সেই স্মৃতি, রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের সেই স্মৃতিবহ মহান শহীদ দিবস অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আজ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতির জীবনে শোকাবহ, গৌরবোজ্জ্বল, অহংকারে মহিমান্বিত চিরভাস্বর দিন। সব পথ এসে আজ মিলে যাবে জাতির এক অভিন্ন গন্তব্যে, ভালোবাসার শহীদ মিনারে। হাতে হাতে বসন্তের সদ্য ফোটা ফুলের স্তবক, কণ্ঠে নিয়ে চির অম্লান সেই গান- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি।’ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে হয় দেশভাগ। জন্ম হয় পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের। জন্মের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার অপচেষ্টা চালায়। এর প্রতিবাদে যে আন্দোলন শুরু হয়, তার চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন বাংলাকে এ দেশের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল বের করে ছাত্র-জনতা। সেই মিছিলে নির্বিচার গুলি চালায় পুলিশ। রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, শফিকসহ নাম না জানা অনেকের রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। তাঁদের রক্তের পথ বেয়েই বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায়। ভাষার জন্য আত্মদানের গর্বে গর্বিত বাঙালি আজ পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে সেই সব উত্তরসূরিকে, যাঁদের বুকের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে কেবল বাংলা ভাষায়ই নয়; বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সব ভাষাভাষীর ভাষার অধিকার। ভাষাসংগ্রামের ইতিহাসে তাই রক্ত-পলাশের মতো ফুটে আছে একুশে ফেব্রুয়ারি। আজ বাংলাদেশ শুধু নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বর্ণময় কর্মসূচিতে স্মরণ করা হবে দিবসটি। বাঙালি-অবাঙালি সব মানুষ আজ এক হয়ে গাইবে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গকারীদের উদ্দেশে গান; শ্রদ্ধায় নিবেদন করবে পুষ্পের অর্ঘ্য। বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বজুড়ে ছোট-বড় সব শহীদ মিনারে নামবে মানুষের ঢল। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে মহান একুশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও পালিত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও নিজ নিজ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। দল-মত-নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ আজ নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে।

