১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ  । ১লা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ 

রাষ্ট্রপতি ও উচ্চকক্ষ নিয়ে বিভাজন

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অধীনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলমান সংলাপ দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক কাঠামো নির্ধারণে এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তমালা দেশের সাংবিধানিক কাঠামোতে এক নতুন মাত্রা যোগ করতে যাচ্ছে। তবে সংস্কারের পথে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা সহজ নয়, বরং বিভিন্ন দল ও জোটের মধ্যে গভীর মতানৈক্য বিদ্যমান। বিশেষ করে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন, পিআর পদ্ধতি এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ নিয়ে যে ভিন্নমত ও ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেখা যাচ্ছে, তা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্থিতিশীল ব্যবস্থার জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। ঐকমত্য কমিশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলো ১০০ আসনের একটি উচ্চকক্ষ গঠন করা, যার সদস্যরা নিম্নকক্ষে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ অনুযায়ী আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে মনোনীত হবেন। এই পদ্ধতিকে বিএনপি, ১২ দলীয় জোট এবং এনডিএম প্রত্যাখ্যান করে নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের প্রতিনিধি নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। অন্যদিকে সিপিবি, বাসদ ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম উচ্চকক্ষের ধারণারই বিরোধিতা করেছে, যা দেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলে তাদের মত। এই প্রেক্ষাপটে উচ্চকক্ষের ক্ষমতা সীমিত রেখে তাকে শুধু পর্যালোচনামূলক ভূমিকায় রাখার প্রস্তাব এসেছে। এই মতপার্থক্য শুধু পদ্ধতিগত নয়, বরং ক্ষমতা ও প্রতিনিধিত্বের দর্শনগত ভিন্নতাও প্রকাশ করে। কমিশন কর্তৃক পিআর পদ্ধতিকে চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত তাই ভবিষ্যতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হতে পারে। একইভাবে পিএসসি, দুদক, সিএজি এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়েও বিএনপি ও সমমনা দলগুলো আপত্তি জানিয়েছে। তারা নিয়োগের জন্য শক্তিশালী আইন প্রণয়নের পক্ষে থাকলেও সাংবিধানিক বিধানের বিরোধিতা করেছে। তাদের এই অবস্থান প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলতে পারে। অন্যদিকে তিন বাহিনী ও দুই গোয়েন্দাপ্রধান নিয়োগের ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়াই সরাসরি রাষ্ট্রপতির হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব, রাষ্ট্রপতিকে আরো শক্তিশালী করে ক্ষমতার ভারসাম্য বাড়ানোর একটি প্রচেষ্টা। তবে একে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার নিশ্চয়তা অত্যাবশ্যক। সংলাপের এক পর্যায়ে সংবিধানের চার মূলনীতি বাদ দেওয়ার প্রশ্নে বাম দলগুলোর সংলাপ বর্জন করে। বাম দলগুলোর মতে, মুক্তিযুদ্ধের সনদ হিসেবে এই মূলনীতিগুলো অক্ষুণ্ন রাখা অপরিহার্য। এই ধরনের মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য না হওয়া ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় প্রশ্ন। ঐকমত্য কমিশনের কাজ হলো একটি সর্বজনীন ও টেকসই রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য দলগুলোর মধ্যে বোঝাপড়া তৈরি করা। কিন্তু যখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা সংলাপ বর্জনের মতো ঘটনা ঘটে, তখন তা ঐকমত্যের প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে দেয়। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভিন্নমত থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু সেগুলোকে আলোচনার মাধ্যমে একটি কার্যকর সমাধানের দিকে নিয়ে যাওয়াই কমিশনের মূল দায়িত্ব। জুলাই অভ্যুত্থানের পর ‘নতুন বাংলাদেশ’ গঠনের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তা পূরণের জন্য দলগুলোর মধ্যকার মতপার্থক্য নিরসন এবং একটি সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। নতুবা সংস্কারের এই প্রচেষ্টাগুলো শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে এবং দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর হবে না।

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়