১৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ  । ২রা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ 

কলঙ্কময় অধ্যায়ের স্বীকারোক্তি

জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলোতে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও দমন-পীড়নের ঘটনাগুলো দেশের বিবেকবান মানুষকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। সেসব নৃশংসতার পেছনের অন্ধকার দিকগুলো ধীরে ধীরে আলোর মুখ দেখছে। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের রাজসাক্ষী হিসেবে দেওয়া জবানবন্দি সেই কলঙ্কজনক অধ্যায়ের এক মর্মন্তুদ স্বীকারোক্তি, যা আমাদের রাষ্ট্রের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ঘাপটি মেরে থাকা অমানবিকতার এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে।​মামুনের সাক্ষ্য অনুযায়ী, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সরাসরি নির্দেশে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলন দমন করা হয়। এই সাক্ষ্য কেবল একজন সাবেক কর্মকর্তার ব্যক্তিগত স্বীকারোক্তি নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের সুস্পষ্ট অভিযোগ। আইজিপি হিসেবে মামুন নিজেই বলেছেন যে তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ও ডিবির প্রধান হারুন অর রশিদ এই বর্বরতার অন্যতম প্রধান কুশীলব ছিলেন। এটি প্রমাণ করে যে হত্যাকাণ্ডগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা ছিল না, বরং রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে সুপরিকল্পিতভাবে নির্দেশিত ও বাস্তবায়িত হয়েছিল।
​সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো, মামুন তাঁর সাক্ষ্যে বলেছেন যে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপস, ওবায়দুল কাদেরসহ আরো অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলেন। এই তথ্য থেকে বোঝা যায়, দমন-পীড়নের সিদ্ধান্তটি কেবল সরকারের ক্ষুদ্র একটি অংশের ছিল না, বরং তা ছিল একটি বৃহৎ চক্রের সম্মিলিত প্রয়াস।​মামুনের এই সাক্ষ্য এক ঐতিহাসিক ও নৈতিক চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে এনেছে। একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তি যখন তাঁর ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চান, তখন তা একটি জাতির জন্য এক নতুন পথের দিশা হতে পারে।
‘আমি লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী’—মামুনের এই কথাগুলো প্রমাণ করে যে বিবেকের দংশন কতটা শক্তিশালী হতে পারে। তবে তাঁর এই অনুতাপ কেবল ব্যক্তিগত অনুশোচনা হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। ট্রাইব্যুনালে দেওয়া তাঁর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে এমন নৃশংসতা চালানোর দুঃসাহস না দেখায়।​মামুনের এই সাক্ষ্য জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই স্বীকারোক্তি সেসব পরিবারের জন্য কিছুটা হলেও সান্ত্বনা নিয়ে আসতে পারে, যারা তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছে।
এখন এই তথ্যগুলোর ভিত্তিতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচারপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করা জরুরি। দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে এই বিচার অপরিহার্য। এটিই হবে জুলাইয়ের শহীদদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও অঙ্গীকারের বাস্তব প্রতিফলন।

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়