শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড। অথচ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপে যে ফলাফল বা ধারণা পাওয়া যায়, তাতে প্রায় দ্বিধাহীনভাবেই বলা চলে, জাতির মেরুদণ্ড ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে কুঁজো হতে বা শয্যাশায়ী হতে সময় লাগবে না। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে শিক্ষার মান ক্রমে নিচের দিকে নামছে।শিক্ষার্থীদের পাঠদক্ষতা, বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ও বাস্তবে প্রয়োগক্ষমতায় বড় ধরনের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অঙ্গনে বাংলাদেশের ডিগ্রির মান অবনমনেরও খবর আসছে।
বিশ্বব্যাংকের চলতি বছরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শিক্ষার মান নিয়ে বলা হয়, একটি শিশু ১৮ বছর বয়সে সাধারণত ১১ বছর মেয়াদি আনুষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করে (প্রথম শ্রেণি থেকে একাদশ শ্রেণি)। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের শেখার মান বিবেচনায় আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ৬.৫ বছরের সমতুল্য।
অর্থাৎ শিক্ষায় আন্তর্জাতিক মানে বাংলাদেশ অন্তত ৪.৫ বছর পিছিয়ে। সে ক্ষেত্রে দেশের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মান আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সপ্তম শ্রেণির সমান, যা শিক্ষার গুণগত দুর্বলতার বড় প্রমাণ। সাম্প্রতিক বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রাথমিক পর্যায়ের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী পাঠ্যবই ঠিকভাবে পড়তে পারে না। বিশ্ব র্যাংকিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ভালো জায়গা করে নিতে পারছে না।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫১ শতাংশ বাংলায় এবং ৩৯ শতাংশ গণিতে শ্রেণি বিবেচনায় প্রত্যাশিত দক্ষতা অর্জন করেছে। পঞ্চম শ্রেণির ক্ষেত্রে বাংলায় এই হার ৫০ ও গণিতে ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মাতৃভাষা বাংলায়ই অর্ধেক শিক্ষার্থী দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন বিভাগের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনেও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের দুর্বলতার চিত্র উঠে আসে। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থীর ইংরেজিতে অবস্থা খারাপ।একই শ্রেণিতে গণিতে ৪৩ শতাংশের অবস্থা খারাপ। অষ্টম শ্রেণিতে ইংরেজিতে ২৮ শতাংশ মোটামুটি ভালো, অন্যরা নানা স্তরে রয়েছে। ওই শ্রেণিতে গণিতে ৩৬ শতাংশ মোটামুটি ভালো অবস্থায় আছে।
২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলেও শিক্ষার মানের একটি চিত্র উঠে আসে। ওই শিক্ষাবর্ষে বিজ্ঞান ইউনিটে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ৯৪ শতাংশ অকৃতকার্য। কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটেও ৯০ শতাংশের বেশি ভর্তীচ্ছু ফেল করেছে। এই দুই ইউনিটের পরীক্ষায় এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পাওয়া এক লাখ ২১ হাজার শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি।শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অন্যান্য সূচকেও পিছিয়ে বাংলাদেশ। ২০২২ সালে ইউএনডিপি এবং মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম নলেজ ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে ১৫৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২০তম। জাতিসংঘের সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশনের প্রকাশিত ২০২১ সালের বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচকে ১৩২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৬ নম্বরে। উদ্ভাবন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নিচে আছে বাংলাদেশ।
নিকট অতীতে লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে গিনিপিগ বানিয়ে শিক্ষার মানোন্নয়নের নামে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। সেসবের সঙ্গে না শিক্ষক, না শিক্ষার্থী কেউই নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেনি। আর তার ফল হয়েছে উল্টো। বিদেশের টুকরা টুকরা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ করতে হবে। সুপরিকল্পিতভাবে শিক্ষার মানোন্নয়নে কাজ করতে হবে।

