দেশের অর্থনীতি নানামুখী সংকটে জর্জরিত। নতুন বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ। প্রতিনিয়ত কর্মক্ষম জনসংখ্যা বাড়ছে, অথচ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। চালু কলকারখানাও একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।এরই মধ্যে তিন শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বেকারের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলেছে। শিল্প-বিনিয়োগের এমন দুরবস্থার পেছনে বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার এবং ঋণপ্রবাহ অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়া। এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, মুদ্রাস্ফীতি, বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকটসহ আরো অনেক কারণেই দেশের শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য ধুঁকছে।
অর্থনীতি ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে।
সরকারি তথ্যেও উঠে আসছে দুর্দশার এমন চিত্র। সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ-জিইডি প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, উচ্চ সুদ আর কম ঋণই এখন অর্থনীতির বড় সংকট। ব্যাংকিং খাতের এই দুই সংকট বিনিয়োগের গতি ক্রমেই কমিয়ে দিচ্ছে।
এই দুই সূচক উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগচক্র পুনরুদ্ধারের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই বিভাগের নভেম্বর মাসের ইকোনমিক আপডেটে এ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটি সোমবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধান উপদেষ্টার সামনে উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনে দেখানো হয়, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ দাঁড়িয়েছে ৬.২৯ শতাংশ, যা আগের মাসের ৬.৩৫ শতাংশ থেকে আরো কম। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত ঋণ লক্ষ্যমাত্রা ৭.২ শতাংশের অনেক নিচে।
নিকট অতীতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল গড়ে ১২ শতাংশের মতো। অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, ঋণের এই নিম্নমুখী প্রবাহের অর্থ দাঁড়ায়, বিনিয়োগ কার্যত ‘ডেড জোনে’।
ব্যাংকিং খাতের অবস্থাও সুবিধাজনক নয়। উচ্চ খেলাপি ঋণের ঝুঁকিতে থাকা অনেক ব্যাংক এখন কম ঝুঁকিপূর্ণ সরকারি ঋণের দিকে বেশি ঝুঁকছে। ফলে সেপ্টেম্বর মাসে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ দাঁড়িয়েছে ২৪.৪৫ শতাংশ, যা বেসরকারি খাতের বিপরীতে এক অসম চাপ তৈরি করছে। এ অবস্থাকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন ‘ক্রাউডিং আউট’, যেখানে সরকারের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণের কারণে বেসরকারি খাতের জন্য অর্থায়নের জায়গা সংকুচিত হয়।
ব্যাংকিং খাতের এ সংকট সরাসরি মুদ্রানীতির লক্ষ্যকেও ব্যাহত করছে। উচ্চ সুদ, সীমিত ঋণ এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে ব্যবসায়ীরা নতুন যন্ত্রপাতি আমদানিও কমিয়ে দিয়েছেন। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, জুলাইয়ে ৪৫৫.৯৩ মিলিয়ন ডলার থেকে কমে হয়েছে ২৬৭.১ মিলিয়ন ডলার। যদিও আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে সামান্য স্থিতি দেখা গেছে, তবে এটি সংকট কাটছে এমন কোনো নির্দেশনা দেয় না।এর ফলে অর্থনীতির বিনিয়োগচক্রে গভীর প্রভাব পড়ছে। নতুন প্রকল্প কমে যাচ্ছে, কর্মসংস্থান কমছে এবং উৎপাদন সম্প্রসারণ থমকে আছে। অর্থনীতির এই স্থবিরতা এমন সময় দেখা দিচ্ছে, যখন সরকার উন্নয়ন ব্যয়ও কম করেছে এবং স্থানীয় রাজস্ব সংগ্রহের টার্গেট পূরণের ক্ষেত্রেও ২২.৬৩ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছে।
আমাদের ক্ষুদ্র এই দেশটির জনসংখ্যা ১৮ কোটি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কর্মসংস্থান ও আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করতে হবে। আর তা সম্ভব দ্রুত শিল্পায়নের মাধ্যমে। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উল্টোটা। শিল্প খাত এগোনোর বদলে পিছিয়ে পড়ছে। নীতিনির্ধারকদের দ্রুত এ বিষয়ে ভাবতে হবে।

