প্রতিদিনের ডেস্ক॥
গণরোষের মুখে গত সোমবার ক্ষমতা ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি পদত্যাগ করায় মন্ত্রিসভাও ভেঙে গেছে। অন্যদিকে, মঙ্গলবার সংসদ ভেঙে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। এর ফলে দেশ পরিচালনার জন্য যে ধরনের সাংবিধানিক সরকার কাঠামো দরকার হয়, সেটি এখন নেই। গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটার পর থেকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির মুখে ইতোমধ্যেই সংসদ ভেঙে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ গ্রহণ বৃহস্পতিবার বিকালে অথবা সন্ধ্যায় হতে পারে। বুধবার (৭ আগস্ট) সেনা সদর দপ্তরে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা জানান তিনি। ওয়াকার উজ জামান বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে ড. ইউনূস আগামীকাল বৃহস্পতিবার দায়িত্ব নেবেন। তিনি দুপুরে এসে পৌঁছাবেন, আমি তাকে রিসিভ করবো। আগামীকাল বিকালে বা রাত ৮টা নাগাদ শপথ গ্রহণ হতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আপাতত ১৫ জন সদস্য থাকতে পারে বলে তিনি আভাস দেন। দেশে পুলিশের যে অনুপস্থিতি রয়েছে, খুব তাড়াতাড়ি সেই সমস্যার সমাধান হবে বলে তিনি মনে করেন। সেনাবাহিনী প্রধান বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি ছাড়াও রাজনৈতিক দল ও ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সবার সম্মতিক্রমে ড. ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ নামে কোন ব্যবস্থার উল্লেখ নেই। তবে কাছাকাছি ধরনের একটি ব্যবস্থার কথা আগে বলা ছিল, যেটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নামে পরিচিত। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ২০১১ সালে এই ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ক্ষমতায় থাকা সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর ওই সরকারই বিজয়ী রাজনৈতিক দল বা জোটের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। কিন্তু নির্বাচন ছাড়াই হুট করে সরকারের পতন ঘটায় বর্তমানে দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটি বিবেচনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দাবি উঠেছে। অথচ এ ব্যাপারে সংবিধানে কিছুই বলা নেই, বলছিলেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক। মূলতঃ সে কারণেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ঘিরে আইনগত এক ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
সংবিধানকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি বলা হয়ে থাকে। ফলে এটি না থাকলে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে নানান সমস্যা ও সংকট তৈরি হবে। এখন সংবিধানে উল্লেখ না থাকলেও প্রয়োজনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে কি? কোন উপায় কি আছে? সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক বলেন, উপায় অবশ্যই আছে, তবে সেটি করতে হলে বর্তমান সংসদ বহাল রেখেই সরকার গঠনের চেষ্টা করতে হবে। এক্ষেত্রে বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে যতজনকে পাওয়া যায়, তাদেরকে নিয়েই নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করতে হবে। সংবিধান রক্ষার স্বার্থে এটি নামমাত্র মন্ত্রিসভা হবে। তাদেরকে দিক নির্দেশনা দেয়ার জন্য উপদেষ্টামণ্ডলী রাখা হবে এবং তারাই রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ইতোমধ্যেই সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। যদিও সংবিধান অনুযায়ী সে এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির আছে কী-না, সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, এককভাবে সংসদ বিলুপ্ত করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির নাই, বলেন আইনজীবী শাহদীন মালিক। তিনি আরো বলেন, সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীর লিখিত পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সংসদের অধিবেশন আহ্বান, সমাপ্তি এবং সংসদ বিলুপ্তি করবেন। সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদের এক নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি বিজ্ঞপ্তি দ্বারা রাষ্ট্রপতি সংসদ আহ্বান, স্থগিত ও ভঙ করিবেন….তবে আরে শর্ত থাকে যে, এই দফার অধীন তাহার দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক লিখিতভাবে প্রদত্ত পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন। কিন্তু নির্বাহী আদেশে ইতোমধ্যেই সংসদ ভেঙে দেয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে এখন কী করার আছে? পোস্ট ভ্যালিডিটি দিয়ে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ গঠন করা যাবে, বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশেষ ক্ষমতাবলে কোন পদক্ষেপ নেয়ার পর সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে পরবর্তীতে সেটির বৈধতা দেয়াকে আইনের ভাষায় ‘পোস্ট ভ্যালিডিটি’ বা দায়মুক্তি বলা হয়ে থাকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের পর গৃহিত সামরিক শাসনের সব কর্মকাণ্ডকে ১৯৭৯ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেয়া হয়েছিল। একইভাবে, ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেয়া হয়েছিলে আরেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে। যদিও সামরিক শাসনের বৈধতা দেয়ার পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীকে ২০১০ সালে অবৈধ ঘোষণা করে উচ্চ আদালত। গণঅভ্যূত্থানে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদ সরকারের পতনের পর পঞ্চম সংসদের নির্বাচন পরিচালনার জন্য তিন মাসের অন্তর্বর্তীকালীন বা অস্থায়ী একটি সরকার গঠন করা হয়েছিল। সে সময় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ আন্দোলনকারী সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সেই অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়েছিল। সেজন্য বিচারপতি আহমদকে প্রথমে উপরাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব দেয়া হয় এবং এরপর তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়া তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব পালনের পর নির্বাচন শেষে প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে গিয়েছিলেন। এই দু’টি বিষয়ে বৈধতা দেয়া হয়েছিল সংবিধানের একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। উনিশ’শ একানব্বই সালে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পঞ্চম সংসদে এই সংশোধনী পাস করা হয়।

