বিএনপির বর্জনে আওয়ামী লীগের অর্জন

0
44

মোস্তফা হোসেইন
নির্বাচনে অংশ না নিয়েও এই নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলো বিএনপি। অদৃশ্য প্রার্থিতা ছিলো প্রতিটি আসনে। সবশেষে জয়-পরাজয় চোখের সামনে। বিএনপি ভোটের দিনই তাদের বিজয় ঘোষণা করেছে। বলেছে, জনগণ নির্বাচন বর্জন করার মাধ্যমে তাদের অসহযোগ আন্দোলন সফল করে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ আকাশচুম্বী বিজয় লাভ করেছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে। প্রথাগতভাবে বিএনপি এই বিজয়কে পাতানো নির্বাচনের ফল বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনের পরদিন সোমবার সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে,তারা নির্বাচন বাতিল করে নতুন নির্বাচন চান।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নির্বাচনের সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। নির্বাচনে ভোট কম পড়লেও স্বচ্ছ-সুন্দর নির্বাচন হয়েছে এমন মন্তব্য করেছে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকগণও। ভোটার উপস্থিতি বিষয়ে তাদেরও একই মত। একইসঙ্গে প্রায় সবাই বলেছেন,গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটার সংখ্যা নির্ধারিত না থাকায় নির্বাচনকে সুষ্ঠু বলতে বাধা ছিলো না।
বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সুফল পেয়েছে আওয়ামী লীগ, আর বিএনপির ক্ষতিটা যে কত বড় তা বোঝা যাবে শিগগিরই, যখন তাদের আন্দোলনগুলো আরও ম্রিয়মাণ হবে, জনসম্পৃক্ততা যখন আরও ক্ষয়িষ্ণু হবে।
বিএনপি যে যুক্তরাষ্ট্রকে ভরসাস্থল মনে করেছিলো, সেই মার্কিন দেশীয় পর্যবেক্ষক জিম বেটস বলেছেন, ‘আমি শান্তিপূর্ণ,অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট দেখেছি’। ফিলিস্তিনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসাম খুহাইল বলেন, ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের জন্য ভোটদানের পদ্ধতিটি খুবই সাধারণ ও সহজ ছিলো।
প্রতিটি ভোট দেওয়ায় সময় লেগেছে ১.১৫ সেকেন্ড থেকে আড়াই সেকেন্ড,যা প্রশংসীয়ভাবে দক্ষ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের। কত শতাংশ ভোট পড়ল সেটা রাজনীতির বার্তা, আমাদের জন্য নয়।’ওআইসি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশনের প্রধান শাকির মাহমুদ বন্দর বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন সুসংগঠিত ও শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে।’ একই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির রাজনীতিবিদ ও এমপি মার্টিন ডে, আরব পার্লামেন্টের সদস্য আবদিহাকিম মোয়াল্লিম ও অন্যরা।
লক্ষ্যণীয় নির্বাচনের দীর্ঘদিন আগে থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা স্যাংসন বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা ছিলো। বিএনপি সবসময় বলতো যুক্তরাষ্ট্র তাদের পক্ষে এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতির বিষয়টি বারবার প্রকাশ করেছে, বাংলাদেশের নির্বাচন অনুষ্ঠানে কেউ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলে তার বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচারও পেয়েছে।
সেই যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষকও বললেন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। সুতরাং নির্বাচনের সুষ্ঠু হওয়ার বিষয়ে আর কারো দ্বিমত থাকার অবকাশ নেই। বরং তাদের বাংলাদেশে উপস্থিতকালে তারা দেখেছেন, কিভাবে চট্টগ্রামে বিএনপি প্রকাশ্য দিনের বেলা পুলিশকে আক্রমণ করেছে, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে বাধা প্রদান করেছে। এখন তারা তাদের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন সেটা তাদের বিষয়।
নির্বাচনের পরদিন চিন আনুষ্ঠানিকভাবে মন্তব্য করেছে স্বচ্ছ ও সুন্দর নির্বাচন হয়েছে বলে। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর মতো ভারতীয় সরকারও যে নির্বাচন বিষয়ে একইমত প্রকাশ করবে তা স্বাভাবিক। এবং তারা পরদিনই শেখ হাসিনাকে অভিনন্দনও জানিয়েছে। তাহলে এই নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে বিতর্কের কিছু অবশিষ্ট থাকছে না। নির্বাচন পরবর্তী বিএনপির প্রথম আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নতুন নির্বাচন দাবির যৌক্তিকতা স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্নের মুখে পড়ে।
পরদিন বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকগণ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে একবাক্যে স্বীকার করেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার কথা। একইভাবে নির্বাচনের পরদিন বেশ কিছু দেশের রাষ্ট্রদূতগণও বলেছেন, অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে, যা প্রশংসারও দাবি রাখে।
একইসঙ্গে আবারও বিএনপির রাজনীতিও বিশ্লেষণ করা যায়। নির্বাচন বর্জন করে রাজনৈতিকভাবে কতটা সুফল লাভ করছে তারা। সব বর্জনে কি অর্জন হয়? ২০১৪ সালের বর্জনে আওয়ামী লীগের অর্জন হয়েছিলো। ২০২৪ এর বর্জনেও ফল পেয়েছে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ বিষয়ে বিশ্বজনমত ছিলো নেতিবাচক। যদিও সবদেশই মেনেও নিয়েছিলো। কিন্তু এবার নির্বাচনের দিন থেকেই নির্বাচনকে সুষ্ঠু হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ফলে বিএনপির দাবির অসারতা প্রমাণ হলো সবদেশ ও সবমহল থেকে।
তারা নির্বাচন বর্জনই শুধু নয়, দেশে অসহযোগ আন্দোলনেরও ডাক দিয়েছিলো। সুষ্ঠু নির্বাচনের পর জনগণ যে তাদেরই বর্জন করেছে সেটাও প্রমাণ হয়ে গেলো। তাহলে তাদের অর্জনটা কোথায়।
তাদের গ্রাম পর্যায়ে সংগঠন আছে। লাখ লাখ কর্মী-সমর্থক তাদের দলের। সংগঠনভুক্ত সদস্যদের অনেকেই নির্বাচনকালে নীরব ছিলো। কিন্তু বিশাল সমর্থক গোষ্ঠী এই নির্বাচনে কর্মীর ভূমিকা পালন করে। তারা আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের এবং স্বতন্ত্র কিংবা ক্ষুদ্রদলগুলোর প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছে। যে কারণে দলের সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। যা আগামীতে আরও বাড়বে। এই বর্জনের ফল তারা ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকেই পেতে শুরু করেছে। মনে হয় না নেতাদের চোখে পড়েছে।
তারা যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতো, তাহলে ২০১৪ সালের মতো বিতর্কিত অবস্থানে যাওয়া আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্ভব হতো না। আর যদি আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের মতো বিতর্কিত অবস্থানে থাকতোও তাহলেও বিএনপির ক্ষতির পরিমাণ হতো এখনকার চেয়েও কম। অন্তত তাদের বিশাল কর্মীবাহিনী মাঠে থাকতো।
দলের প্রতি তাদের সংশ্লিষ্টতা থাকতো। তাদের আন্দোলন অন্তত চলমান থাকার মতো অবস্থায় থাকতো। মনে রাখার বিষয় হচ্ছে-তাদের যেসব কর্মী সমর্থক এই নির্বাচনে কোনো প্রার্থীকে সমর্থন করেছে এবং তাদের সমর্থিত ব্যক্তি নির্বাচিত হয়েছে, সেই কর্মীকে আর ফিরিয়ে আনা বিএনপির পক্ষে সম্ভব হবে না। ফলে কর্মী এবং দলের দূরত্ব না বলে বিচ্ছিন্ন হওয়া বললেই যথার্থ হবে।
বর্জনে যে অর্জন নেই সেটা সম্ভবত বাংলাদেশের বাংলাদেশের জন্মসমর্থক ১৯৭০ সালের নির্বাচন মাধ্যমে প্রথম প্রমাণ হয়েছে।বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশাল জনপ্রিয়তার অধিকারী মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ন্যাপ নির্বাচন বর্জন করেছিলো। ওই সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মাটি কাঁপানো সমর্থন ছিলো দলটির প্রতি। আজকে সেই ন্যাপ বিস্মৃতপ্রায়। এই মুহূর্তে বিএনপি বিরোধীরা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সিদ্ধান্তের সঙ্গে বিএনপির সিদ্ধান্তকে মিলিয়ে নিতে চাইছেন।
তবে বিশ্লেষকগণ বিএনপির এই বর্জনকে স্বভাবগত কিনা তাও আলোচনা হচ্ছে। ২০১৮ নির্বাচনে তারা ৭ আসন পায়। এ নিয়ে তাদের প্রচণ্ড ক্ষোভ আছে। সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু নির্বাচন বর্জন না করলেও তারা মির্জা ফখরুল ইসলামের মতো নেতার পদ বর্জনের মধ্য দিয়ে যে বর্জনের পথ ধরে, শেষ পর্যন্ত তারা ৬ এমপির পদত্যাগ মাধ্যমে তার পূর্ণতা লাভ করে।
মির্জা ফখরুল ইসলামের মতো নেতাকে তারা কেন সংসদে পাঠায়নি এই প্রশ্ন কিন্তু সবসময়ই থাকবে। তারপর নির্বাচিত এমপিদের সবাই পদত্যাগ করে বর্জনের আরেকটি ধাপ পাড়ি দিলো তারা। অথচ তারা যখন সংসদে ছিলো সরকারের সমালোচনা করার শতভাগ সুযোগ তারা পেয়েছিলো। তখন তাদের আন্দোলন ছিলো সংসদের ভিতরে ও রাজপথে।
একবারে নাম করেও যদি বলা হয়, তাহলে অন্তত দুইজনের কথা বলতে হবে। তাদের মনোনীত এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা এবং নির্বাচিত এমপি হারুনুর রশিদ যেভাবে সংসদ মাতিয়ে রেখেছিলেন, যা সারাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে, বিএনপির বক্তব্যগুলোকে অনুধাবন করেছে, সংসদ ত্যাগ করার পর এই দুই এমপি কি আর সেই সুযোগ পেয়েছেন। সংসদ থেকে বের হওয়ার পর তারা অন্তরালে চলে যান। এতে বিএনপির অর্জন নয় ব্যাপক ক্ষতিই হয়েছে।
বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সুফল পেয়েছে আওয়ামী লীগ, আর বিএনপির ক্ষতিটা যে কত বড় তা বোঝা যাবে শিগগিরই, যখন তাদের আন্দোলনগুলো আরও ম্রিয়মাণ হবে, জনসম্পৃক্ততা যখন আরও ক্ষয়িষ্ণু হবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, গবেষক, কলামিস্ট।