দীপান্বিতার মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা, ইট পড়ার উৎস জানে না পুলিশ

0
17

প্রতিদিনের ডেস্ক
প্রতিদিনের মতো অফিস শেষে বাসায় ফিরছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা দীপান্বিতা বিশ্বাস। অফিসের বাসেই আসা-যাওয়া করেন। নামেন শান্তিনগর। সেখান থেকে হেঁটেই ঢাকার মগবাজারের গাবতলার বাসায় ফেরেন। প্রতিদিন এতটুকু পথ হেঁটে যাতায়াত করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন তিনি। বৃহস্পতিবার ঘরে ফিরতে পারলেই দুদিনের সাপ্তাহিক ছুটি। কিন্তু তার আগেই থেমে যায় তার জীবনের ক্যালেন্ডার। একটি ইট তথনছ করে দেয় তার ভালোবাসার সংসার।
গত ১০ জানুয়ারি হেঁটে বাসায় ফেরার সময় মৌচাক মার্কেট সংলগ্ন ফখরুদ্দীন পার্টি সেন্টারের সামনে আচমকা একটি ইট এসে পড়ে দীপান্বিতার মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন তিনি। আশপাশ থেকে কয়েকজন মানুষ দৌড়ে আসেন তখন। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না তারা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দীপান্বিতাকে ঘিরে ভিড় জমে যায়। ততক্ষণে সব শেষ। পরে একটা রিকশায় নিথর দেহ তুলে দেন তারা।
দীপান্বিতা নিহত হওয়ার ঘটনায় রমনা মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন তার স্বামী তরুণ বিশ্বাস। তবে ঘটনার ছয়দিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশ এখনো শনাক্ত করতে পারেনি ইটটি কোথা থেকে কীভাবে পড়লো। এছাড়া কাউকেই এ ঘটনায় গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ধোঁয়াশা। দীপান্বিতাকে টার্গেট করে ইট ফেলা হয়েছে, নাকি ফ্লাইওভার থেকে ইট পড়েছে সেটিই তদন্ত করছে পুলিশ। একাধিক সিসি ক্যামেরার ফুটেজও সংগ্রহ করেছে তারা। তবে ইট কোথা থেকে পড়ছে সিসি ক্যামেরায় এমন দৃশ্য খুঁজে পাচ্ছে পুলিশ
এ ঘটনায় নিহতের পরিবারকে ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছেন দীপান্বিতার এক বন্ধু। তিন বছরের ছেলে ঋষি রাজ সারাক্ষণ মাকে খুঁজে ফিরছে। অবুঝ শিশুটি অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার মা হয়তো অফিস শেষে বাসায় ফিরবে। কিন্তু প্রতিদিন সন্ধ্যা হলেও আর বাসায় ফেরে না রাজের মা।
দীপান্বিতার পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। দীপু সানা নামেও পরিচিত তিনি। ছিলেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। বিসিএসের পর বেশির ভাগ তরুণ-তরুণী যে জায়গাটিতে চাকরির স্বপ্ন দেখেন, সেটি বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়োগ পরীক্ষার বিশাল যুদ্ধ শেষে দীপু ২০১৭ সালে সেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নিয়োগ পেয়েছিলেন।
ব্যাংকটিতে তার সহকর্মী জাহাঙ্গীর ফিরোজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘দীপু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদরঘাট শাখায় কর্মরত ছিলেন। অফিসার পদে তিনি যোগদান করেন। দুই বছর পর পদোন্নতি পেয়ে সহকারী পরিচালক হন।’
দীপু ও তরুণ দুজনের গ্রামের বাড়িই খুলনার আলাদা আলাদা উপজেলায়। তরুণ পড়েছেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুজনের মধ্যে ছিল কয়েক বছরের প্রেমের সম্পর্ক। পরবর্তীসময়ে পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে করেন তারা। ক্যারিয়ারের দিক দিয়েও দুজনে ছিলেন সফল। তরুণ একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করেন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। তাদের ভালোবাসার ঘরে আলো করে আসে একটি সন্তান- ঋষি রাজ। প্রেম, বিয়ে, ক্যারিয়ার- সবকিছু মিলিয়ে দারুণ একটি সংসার। কিন্তু সেখানে আজ নেমে এসেছে অন্ধকার।
দীপান্বিতার মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ীদের বিচারের দাবি জানিয়েছেন তার সহপাঠী ও সহকর্মীরা। সহপাঠী বিজয় বলেন, ‘আজ দ্বীপান্বিতার জায়গায় আমি থাকতে পারতাম, আপনিও থাকতে পারতেন। আমরা এ ধরনের মুত্যু দেখতে চাই না, আমরা একটা বাসযোগ্য নগরী চাই, সবাই যাতে নিরাপদে তার জীবনধারণের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। তার সহপাঠী হিসেবে আমি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক জিনাত হুদা বলেন, ‘এটি সাধারণ মৃত্যু নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি করছি আমি। বিল্ডিং হবে ঠিক আছে, কিন্তু সেখান থেকে কীভাবে ইট পড়ে? কনস্ট্রাকশন সাইটে নিরাপত্তা ব্যবস্থা তো থাকা দরকার ছিল। এখানে কী ধরনের ঘাটতি ছিল, সেটি খতিয়ে বের করতে হবে।’
দ্বীপান্বিতা তিন বছরের একটি শিশু সন্তান রেখে গেছেন। এই শিশুসহ তার পরিবারকে দেখভালের ব্যবস্থা করতে জিনাত হুদা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ জানান।
দীপান্বিতার স্বামী তরুণ বিশ্বাস বলেন, দীপুর মৃত্যুর ঘটনায় এখন পর্যন্ত পুলিশ কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। আমরা সবাই ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছি। কীভাবে ইট পড়লো, কেউ উদ্দেশ্য করে মারলো কি না এসব বিষয় নিয়েও উদ্বিগ্ন সবাই। তবে পুলিশ বলেছে, তদন্ত করে মূল ঘটনা জানাবে।’
তিন বছরের শিশু সন্তান ঋষি রাজের কথা জনাতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রাজ ছোট হলেও বুঝতে পারে তার মা কয়েকদিন ধরে নেই। সারাক্ষণ মন খারাপ ওর। মাঝে মধ্যে কান্নাকাটি করলে থামানো অনেক কঠিন হয়ে যায়। কারণ কান্নাকাটি করলে ওর মা থাকলে খুব অল্প সময়ে কান্না বন্ধ করতো। এখন রাজকে নিয়েই আমার বেশি চিন্তা। এই ছোট্ট শিশুকে একা কীভাবে বড় করবো। মা ছাড়া একজন সন্তানের কাছে শূন্যতা এর চেয়ে বেশি কিছু হতে পারে না।’
রমনা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উৎপল বড়ুয়া বলেন, ‘দীপান্বিতার মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশসহ একাধিক ইউনিট কাজ করছে। এরই মধ্যে আমরা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। তবে ইটটি ঠিক কোথা থেকে পড়েছিল সেটি শনাক্ত করা যায়নি। যেহেতু তদন্ত চলছে এ কারণে ধারণা করে বলাও মুশকিল। ঘটনার সূত্রপাত উদঘাটন করে যদি কেউ জড়িত থাকে তবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’