শীত-কুয়াশা ভেদ করে শ্রমিকরা ছোটেন জীবনের প্রয়োজনে

0
27

মেহেরপুর প্রতিনিধি
ওরা সবাই শ্রমিক, এসেছেন শ্রম বেচাকেনার হাটে। কাকডাকা ভোরে কনকনে শীত আর কুয়াশা উপেক্ষা করে গ্রাম থেকে এসেছেন শহরে। মানুষগুলো বাঁশের ডালি, কোদাল, দড়ি, দুপুরের খাবারের টিফিন বাটি হাতে ভিড় জমাচ্ছেন ‘মানুষের হাটে’। আর এখান থেকেই শ্রমিক সর্দারদের মধ্যস্থতায় যাবেন মহাজনের (ক্রেতাদের) হাতে। মেহেরপুর জেলা শহরের হোটেল বাজার ও গাংনী উপজেলা শহরের বড়বাজার এলাকায় প্রতিদিন সকালে বসে মানুষ ক্রয়-বিক্রয়ের এই হাট। সরেজমিন দেখা গেছে, ভোর থেকে একে একে জড়ো হতে থাকেন শ্রমজীবী নিম্ন আয়ের রাজমিস্ত্রী, কৃষি শ্রমিক, মাটি কাটা, খোয়া ভাঙা এবং সরকারি প্রকল্পের বিভিন্ন বিল্ডিং ও রাস্তা ঘাটে কাজ করা শ্রমিকরা। সকাল ৮টার মধ্যেই নানা পেশার শ্রমজীবী মানুষে সরগরম হয়ে ওঠে এই শ্রমিক বাজার। তবে শ্রমিক সর্দার বাঁশবাড়িয়া গ্রামের হাসু মিয়া, আযান গ্রামের রুহুল আমিন, জুগিন্দা গ্রামের জামাল উদ্দিন, নারী শ্রমিক সর্দার ইকুড়ি গ্রামের আসমা খাতুন, মালশাদহ গ্রামের ভাদু মিয়া ও ভোলাডাঙ্গা গ্রামের জিয়ারুল ইসলামসহ ৮/১০ জন শ্রমিক সর্দার ভোরে এসে বসে আছেন মহাজনের প্রতীক্ষায়। শ্রমিক সর্দার গাংনী উপজেলা শহরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের গোলাম মোস্তফা জানান, উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রায় ২ থেকে ৩শ জন মানুষ এখানে আসে শ্রম বিক্রি করতে। এখানে ৮/১০ জন শ্রমিক সর্দারের আওতায় এই শ্রমিকরা শ্রম বিক্রি করেন। আমরা মালিকদের সঙ্গে দর কষাকষি করে শ্রমিকদের শ্রম বিক্রি করে থাকি। মালিকরা এসব শ্রমজীবী মানুষকে নিয়ে গিয়ে তাদের যেকোনো কাজ করিয়ে নেন। এখান থেকে রাজমিস্ত্রী, রংমিস্ত্রি, স্যানিটারি মিস্ত্রি, কৃষি শ্রমিক, মাটি কাটা, খোয়া ভাঙা এবং সরকারি প্রকল্পের বিভিন্ন বিল্ডিং ও রাস্তা ঘাটে কাজ করানোর জন্য সহজেই শ্রমিক পাওয়া যায়। তবে অনেক শ্রমিক বিক্রি হলেও অনেককে কাজ না পেয়ে ফিরে যেতে হয় শূন্য হাতে। ভোলাডাঙ্গার শ্রমিক সর্দার জিয়ারুল ইসলাম বলেন কয়েকদিনের দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে কাজ ডাউন হয়ে গেল। এখন কাজ নেই, হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে। এই শীত আর কুয়াশাতে মালিকরাও ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। আমার আন্ডারে ১৪ জন শ্রমিক আছে। এখনো কোনো মালিক আসেনি। আজকে মনে হচ্ছে শূন্য হাতেই ফিরতে হবে। গাংনী পৌরসভার চৌগাছা গ্রামের দিনমজুর রিমা খাতুন বলেন, আবহাওয়ার কারণে কাজ পাওয়া যাইছে না। এখন ইটভাটাতেও কাজ নেই। কয়েকদিন কাজ কইরি এক কেজি বেগুন, তেল আর সামান্য সবজি কিনেই ফুরি গেল টাকা। এখন খাবো কি? আজকেও কাজ হবেনানে। বাড়ি ফিরে যেতে হবে। বুয়ার কাজ খুঁজছি তাও কেউ নিচ্ছে না। রান্নার কাজ পাইলেও তো তিনবেলা খাইয়ি পইরি বাঁচতে পারতাম। পেটের খাবারের জন্য ভিক্ষা করতে বের হবো নাকি বুঝতে পারছিনি। খুব ভোর বেলায় কাজের সন্ধানে শহরে পৌঁছেছেন গাংনী উপজেলার সীমান্তবর্তী কাজিপুর গ্রামের নারী শ্রমিক জবা খাতুন। আজকের দিন যেন খালি হাতে ফিরে যেতে না হয় এজন্য সর্দার গোলাম মোস্তফার হাত ধরছিলেন। জবা বলেন, ভোর বেলায় কোনোদিন ভালো করে ঘুমায়নি। পেট তো আর শুনবেনা। কাজ ভেদে শ্রমিকের দাম যেমন-ধান কাটার শ্রমিক ৪শ থেকে ৫শ টাকা, কৃষি জমি নিরানি শ্রমিক ৩ থেকে সাড়ে ৩শ টাকা, মাটি কাটার শ্রমিক ৪শ টাকা, রাজমিস্ত্রী ৬শ টাকা ও তাদের সহকারী সাড়ে ৪শ টাকা। হাটে শ্রম বিক্রি করতে আসা একজন আনোয়ার মিয়া। পেশায় রাজমিস্ত্রী। অভাবের সংসার, বাধ‍্য হয়ে নিজেকে বিক্রি করতে এসেছেন শ্রম বিক্রির এই হাটে। গাংনী উপজেলার বাতানপাড়ার নারী শ্রমিক জমেলা খাতুন বলেন, পেটে খিদে লাগলি তো আর বসে থাকা যায় না। দৌড়াতে হয় কাজের সন্ধানে। তিনি বলেন, সর্দাররা মালিকদের কাছ থেকে আমাদের জন্য নেয় সাড়ে ৪শ টাকা মজুরি। কিন্তু আমাদের দেন ৪শ টাকা। পুরুষ শ্রমিকরা পান ৫শ/৬ শ টাকা। আমরা গ্রাম থেকে এসে কাজ করি। পথে ১০০ টাকা করে ভাড়া চলে যায়। ৩শ টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। মাশাদহ গ্রামের সুন্নত আলী এসেছেন মানুষের হাটে জমিতে কাজ করানো শ্রমিক কিনতে। তিনি বলেন, মাঠের জমিতে কাজ করাতে হবে। তাই এই বাজারে শ্রমিক কিনতে এসেছি। শ্রমিকের দাম একটু বেশি হলেও এখানে সহজে কাজের লোক পাওয়া যায়।মানুষের এই হাটে বেচাকেনা চলে ভোর থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত। দামদর ঠিক হয়ে গেলে শ্রমজীবী মানুষগুলো রওনা হন মালিকের গন্তব্যে। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ঘাম ঝরিয়ে কাজ করেন কঠোর পরিশ্রমী মানুষগুলো। নারী শ্রমিকদের মজুরি কম ও ৫০ টাকা কেটে নেওয়া প্রসঙ্গে সর্দার গোলাম মোস্তফা বলেন, পুরুষ শ্রমিকরা ভারী ভারী কাজগুলো করে থাকেন। আর নারী শ্রমিকরা অপেক্ষামূলক পাতলা কাজ করেন। এজন্য তাদের মজুরি সামান্য কম। আমরা মোবাইল খরচ করে বিভিন্ন মহাজন ও মালিকদের সঙ্গে কাজের যোগাযোগ এবং গাংনী থেকে কাজের গন্তব্যস্থান পর্যন্ত ভাড়া দিয়ে থাকি। যে কারণে ৫০ টাকা কেটে নেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, নিয়মিত হাট বসলেও মানুষের হাটে কোনো খাজনা নেই, নেই সমিতির ঝামেলা ও হাট কমিটির চাঁদাবাজি। নিজের আপন গতিতেই চলে এই হাট। শ্রমজীবী মানুষরা সেদিক দিয়ে শান্তিতে থাকলেও তাদের কাজের নিশ্চয়তা নেই। হাজারো লোকের ভেতর থেকে মাত্র কয়েকজন বিক্রি হওয়ায় বাকিদের মন খারাপ করে বাসায় চলে যেতে হয়। জানা গেছে, বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ৩ থেকে ৪শ জন মানুষ এখানে আসে শ্রম বিক্রি করতে। পণ্যের মতো দর কষাকষিতে বিক্রি হওয়া শ্রমজীবী এসব মানুষকে নিয়ে যেকোনো কাজ করানো যায়। ক্রয় করে নিয়ে যাওয়া যায় উপজেলাসহ জেলার বিভিন্ন জায়গায়।