স্মৃতি-বিস্মৃতির বিউটি বোর্ডিং

0
25

আহসান হাবিব
বাঙালি বরাবরই আড্ডাপ্রিয়। পাড়ার চায়ের দোকান থেকে ফাইভ স্টার হোটেল পর্যন্ত সবখানেই চলে আড্ডাবাজি। বাকি সব কাজে তা-ও সময়ের হিসাব কোনোরকম থাকলেও বাঙালির আড্ডাতে যেন সময়জ্ঞান সব সময়ই ব্রাত্য! বলা যায়, চব্বিশ ঘণ্টাই আড্ডা দিতে পারার সীমাহীন ক্ষমতা নিয়ে একেকজন বাঙালি জন্ম নেন! আড্ডাবাজির জন্য ওপার বাংলায় যেমন কলকাতার কফি হাউজ কিংবদন্তি হয়ে আছে; তেমনই এপারে বিউটি বোর্ডিং হয়ে আছে ইতিহাসের এক জীবন্ত জাদুঘর।
‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’—মান্না দের কফি হাউজ গানটির বদৌলতে আমরা সাতটি চরিত্রের কথা জানি, যারা কফি হাউজের আড্ডায় মেতে থাকতেন। অসংখ্য মানুষ তাই আজও সেই ফ্লেভারটা নিতে কফি হাউজে যান, যতটা না কফি পান করতে, তার চেয়ে বেশি যান স্মৃতিকাতর হতে। ঠিক একইভাবে আমাদের বিউটি বোর্ডিং আজও কালের সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছে বাঙালিকে স্মৃতির বিরানভূমিতে আচ্ছন্ন করতে। পুরান ঢাকার অন্য দর্শনীয় স্থানের তুলনায় বিউটি বোর্ডিংকে জীর্ণ মনে হলেও এটি জুড়ে আছে সময়ের পদচিহ্ন।
একসময় বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির গুণীজনদের আড্ডা ছিল বিউটি বোর্ডিংয়ে। এটি পুরান ঢাকার বাংলা বাজারের ১ নং শ্রীশদাস লেনে অবস্থিত। এই বাড়ির সাথে বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাস জড়িত। বিউটি বোর্ডিং ছিল নিঃসন্তান জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের আগে সেখানে ছিল সোনার বাংলা নামে একটি পত্রিকার অফিস। কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা মুদ্রিত হয়েছিল এই পত্রিকায়। সোনার বাংলা পত্রিকার ছাপাখানায় নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসুও এসেছিলেন। দেশভাগের সময় পত্রিকা অফিসটি কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। এরপর ১৯৪৯ সালে দুই ভাই প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা ও নলিনী মোহন সাহা এই বাড়ি ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলেন বিউটি বোর্ডিং। নলিনী মোহনের বড় মেয়ে বিউটির নামেই এর নামকরণ করা হয়।
১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ বিউটি বোর্ডিংয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হন প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহাসহ ১৭ জন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে প্রহ্লাদ চন্দ্রের স্ত্রী শ্রীমতী প্রতিভা সাহা দুই ছেলে সমর সাহা ও তারক সাহাকে নিয়ে বিউটি বোর্ডিং আবার চালু করেন। বিউটি বোর্ডিংয়ের জন্মলগ্ন থেকেই এখানে আড্ডা দিতেন প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিক, চিত্রপরিচালক, নৃত্যশিল্পী, গায়ক, অভিনেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
কবি শামসুর রাহমান থাকতেন অশোক লেনে, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক থাকতেন লক্ষ্মীবাজারে আর বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি শহীদ কাদরীর আস্তানা ছিল বিউটি বোর্ডিংয়ের পাশেই একটি ভবনে। ফলে একসময় বিউটি বোর্ডিংয়ে আসতে থাকেন সবাই, পরিচিত হন একে অন্যের সাথে। আবাসিক হোটেলটিতে চায়ের আড্ডায় মেতে থাকেন দিন থেকে রাত। কেউ কেউ কখনো বা রাতেও থেকে যান সেখানে, সৃষ্টি করেন অসংখ্য শিল্পকর্মের। শুধু শিল্প-সাহিত্য নয়, আরও নানা পেশাজীবী মানুষও আসতে থাকেন সেখানে। আসেন অনেক রাজনীতিবিদও।
এই বিউটি বোর্ডিংকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাস জড়িত। বিউটি বোর্ডিং ও এর আড্ডার ইতিহাস চল্লিশের দশক থেকেই সুখ্যাতি লাভ করে। সে সময় এখানে কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আসাদ চৌধুরী, শহীদ কাদরী, হাসান হাফিজুর রহমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, আল মাহমুদ, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, সমর দাশ, সত্য সাহা, জহির রায়হান, গোলাম মোস্তফা, খান আতা, বেলাল চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, সন্তোষ গুপ্ত, শফিক রেহমান, ফয়েজ আহমদসহ বহু বিখ্যাত মানুষ আড্ডা দিতেন বিউটি বোর্ডিংয়ে। টিভি-ব্যক্তিত্ব ফজলে লোহানী, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, জাদুশিল্পী জুয়েল আইচদের দেখা মিলতো বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডায়। এছাড়া চলচ্চিত্র শিল্পের কিংবদন্তি আব্দুল জব্বার বাংলার প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’র চিত্রনাট্য বিউটি বোর্ডিংয়ে বসেই লেখেন। প্রখ্যাত সুরকার সমর দাস বাংল ভাষার বহু বিখ্যাত গানের সুর সৃষ্টি করেছিলেন এখানে আড্ডা দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে।
নতুন ঢাকার কারণে পূর্বের জৌলুস ও গুরুত্ব হারালেও ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক অবিস্মরণীয় সুতিকাগার হলো পুরান ঢাকা। বুড়িগঙ্গা নদী থেকে বাংলাবাজার, হাজির বিরিয়ানি থেকে চকবাজার—পুরান ঢাকা মানে বাঙালির শত শত বছরের এক কালীক-আখ্যান। বিউটি বোর্ডিংয়ের মূল দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে ফিকে হয়ে যাওয়া হলদে রঙের দোতলা বাড়িটা। বাড়ির সামনে সবুজে ঘেরা ফুলের বাগান আর প্রশস্ত উঠান। পাশেই শোবার ঘর, খাবার ঘর, পেছনে সিঁড়িঘর ও উপাসনালয়—সবকিছুই যেন রূপকথার মতো। খাবার ঘরে সারি সারি চেয়ার-টেবিল পাতা।
একসময় এখানে পিঁড়িতে বসে মেঝেতে থালা রেখে খাওয়ানো হতো। এখনো এখানে খাবারের ব্যবস্থা আছে। খাবারের তালিকায় আছে ভাত, ডাল, সবজি, মুড়িঘণ্ট, ভর্তা, বড়া, চচ্চড়ি, সরিষা ইলিশ, রুই, কাতলা, বাইলা, তেলাপিয়া, চিতল, পাবদা, ফলি, বোয়াল, কোরাল, আইড় মাছের ঝোলের মতো নানা সুস্বাদু পদ। বোর্ডিংয়ে আছে সব মিলিয়ে ২৭টি থাকার ঘর। এর মধ্যে ১৭টি সিঙ্গেল বেড ও ১০টি ডাবল বেড। সিঙ্গেল রুমের ভাড়া ২০০ টাকা আর ডাবল রুম ছিল ৪০০ টাকা। তবে এখন আর তেমন লোকজন আসে না এখানে থাকার জন্য। মূলত এখানকার খাবার হোটেলে এখনো নিম্ন আয়ের মানুষরা খাবার খেতে আসেন।
সেই বিউটি বোর্ডিং আর আগের জৌলুসে নেই। অনেকটাই ফিকে হয়ে যাওয়া হলদে ভবনটি কিংবদন্তিদের পদচিহ্ন বুকে নিয়ে আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফিকে হয়ে যাওয়া বাড়িটা দেখে অনেকেই হয়তো বিশ্বাসই করতে চাইবেন না, এখান থেকেই বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরে গিয়েছিল।
পুরান ঢাকার বিউটি বোর্ডিং সেই আখ্যানেরই এক অজর, অক্ষয় কীর্তির নাম। যে বোর্ডিংয়ের আড্ডাগুলো পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশির দশকে আমাদের শিল্পের নিগূঢ় চেতনায় সমৃদ্ধ করে গেছে। যেখানে রচিত হয়েছে অজস্র কালজয়ী কবিতা, উপন্যাস, গল্প, চলচ্চিত্র কিংবা শিল্পকর্ম। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, সাংবাদিক, রাজনীতিক, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব আর জাদুশিল্পীদের পদচারণায় মুখরিত থাকতো সব সময় যে জায়গাটি, তারই নাম বিউটি বোর্ডিং।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।