১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ  । ৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ 

পাকিস্তানের নির্বাচনে পরাজিত গণতন্ত্র

মোস্তফা হোসেইন
উত্তেজনার মধ্যেই পাকিস্তানের নির্বাচন হলো। খুনোখুনির বিষয়টি পাকিস্তানের রাজনীতির অনুসঙ্গ সবসময়ই। এবারও তারা এর বাইরে যেতে পারেনি। এই যেমন নির্বাচনের আগেরদিন অর্থাৎ ৭ ফেব্রুয়ারি বেলুচিস্থান প্রদেশে এক জায়গাতেই বোমা বিস্ফোরণে মারা গেলেন ২৪জন (এনডিটিভির তথ্য অনুযায়ী ২৮জন) । অর্ধশত আহতের অনেকেই আশঙ্কাজনক অবস্থায়। পাকিস্তানের সামরিক সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অন্তত ৫১টি সন্ত্রাসী হামলা তারা মোকাবিলা করেছে। নির্বাচনী সহিংসতায় নিহতের তালিকায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যও আছেন।
এরমধ্যেই নির্বাচনের আগের রাত থেকে দেশটির নির্বাচনকালীন সরকার মোবাইল ফোন সেবা বন্ধ করে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সবই বন্ধ। নির্বাচন কমিশন জানে না কাদের নির্দেশে মোবাইল ফোনের মতো অতি জরুরী যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাদের ক্ষমতা আছে মোবাইল সার্ভিস চালু করার নির্দেশ দেওয়ার। কিন্তু তারা উল্টো জানতে চায়-নিরাপত্তাজনিত কারণে যদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মোবাইল বন্ধ করে দিয়ে থাকে,সেক্ষেত্রে তারা নির্দেশ প্রত্যাহারের কথা বলতে পারে না, তাহলে অঘটন ঘটলে দায় পড়বে নির্বাচন কমিশনের ওপর। যুক্তি হিসেবে কৌতূহল জাগানোর মতো। নির্বাচন কমিশন বরাবরের মতোই বিতর্কিতই থেকে গেছে। নির্বাচনের ফল প্রকাশকালেই পাকিস্তানের পত্রিকাগুলো নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতাকে প্রকাশ করেছে। দ্য ডন সম্পাদকীয়তেই স্পষ্টভাবে নির্বাচন কমিশনকে ব্যর্থ হিসেবে উল্লেখ করেছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফল প্রকাশ করতে না পারার জন্য যতই যুক্তি দেখানো হোক না কেন এটা যে নির্বাচন কমিশনকে দীর্ঘস্থায়ী সমালোচনার মুখে ফেলে দিয়েছে সেটা তারা কোনো যুক্তি দিয়ে দায় সারতে পারবে না। আর এই মোবাইল ফোন বন্ধ রাখার বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আলোড়ন তৈরি করেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিষয়টিকে সরাসরি মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে আখ্যায়িত করেছে।
এ তো গেলো নির্বাচনের দিনের ঘটনা। এমন পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষ নিষেধাজ্ঞা তাদের নির্বাচনের বহু আগে থেকেই শুরু হয়েছে। নির্বাচনকালীন অস্থায়ী সরকার কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন হলেও সেখানে এই সরকারকেও চলতে হয় উর্দি শক্তির অঙ্গুলি নির্দেশনায়। এর মধ্যে আবার বৃহৎশক্তির ক্রীড়ণক হয়ে কাজ করে ওই উর্দি শক্তি। পাকিস্তানের গণমাধ্যম সরাসরি এই প্রসঙ্গটি উল্লেখ করতে না পারলেও পরোক্ষভাবে ঠিকই জানিয়ে দিয়েছে,পাকিস্তানের গণতন্ত্রের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক হচ্ছে সেখানকার সামরিকতন্ত্র।
পাকিস্তানের জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণাই শুধু নয় তার বাক স্বাধীনতা-চলার স্বাধীনতাও হরণ করেছে সেখানকার সরকার। ইমরান খান জনরায়ে দেশটি শাসন করাকালে তার মেয়াদ শেষ হওয়ারও অনেক আগেই ২০২২ সালে অনাস্থা ভোট মাধ্যমে তাকে গদিচ্যুত করে সামরিকতন্ত্র। সেটা প্রকাশ হয়ে পড়েছে ঘটনার পরপরই। তারপর একের পর এক মামলা দায়ের করে তাকে আইনগতভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে।
ইমরান খানকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে আদালতের রায়ের ভিত্তিতে। তিনি ৫ বছরের জন্য কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার হারিয়েছেন। কিন্তু তার দলকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। তার দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধা না থাকায় সামরিকতন্ত্রের সরকার তার দলের পরাজয়কে নিশ্চিত করতে পারেনি। সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য তারা তাদের দলের প্রতীক ব্যবহারেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। একটি দলের প্রধানকে বন্দী করে তার নেতা-কর্মীদের নির্বাচনী অধিকার হরণ করে এই সামরিক সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার স্পষ্টত পক্ষপাতিত্বের প্রমাণ দিয়েছে। এমন অবস্থায় পাকিস্তানের নির্বাচন অনুষ্ঠান হওয়াকে আর যাই হোক লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড এর উদাহরণ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। নির্বাচনী প্রতীক ছাড়া ইমরান খানের দলের নেতারা নির্বাচনে অংশ নিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে এই নিবন্ধ লেখার সময় তার দলীয় ( স্বতন্ত্র হিসেবে অংশগ্রহণকারী) প্রার্থীরা ১০০ আসনে বিজয়ী হওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে।
ইমরান খানের দলের নির্বাচনী সংবাদ প্রচারেও অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। পাকিস্তানের রাজনীতির প্রভাবক শক্তির সদস্যরা সেখানকার সাংবাদিকদের টেলিফোন মাধ্যমে জানিয়ে দিচ্ছে এই সংবাদ প্রচার করা যাবে না ওটা যাবে। আর প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়- এই সেন্সরশিপের খড়গে পড়েছেন মূলত ইমরান খান ও তার দলের নেতা-কর্মীরাই বেশি।
একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থায় যে কোনো দলের প্রতীক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পাকিস্তানে দলের প্রতি আক্রোশ চরিতার্থ করতে গিয়ে দলীয় প্রতীকে আঘাত হানছে সামরিক সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। শুধু ইমরান খানের নির্বাচনী প্রতীকই নয়-পিপলস পার্টির নেতা বিলওয়াল ভূ্ট্টোও অভিযোগ করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নওয়াজ শরিফের প্ররোচনায় তাদের দলের ৭জন প্রাদেশিক পরিষদ ও জাতীয় পরিষদ সদস্যপ্রার্থীর নির্বাচনী প্রতীক পরিবর্তন করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনকে নওয়াজ শরিফের সমর্থক হওয়ার অভিযোগ অবশ্য নওয়াজ শরিফ মানতে নারাজ।
সেনাবাহিনীর নেকনজর আপাতত নওয়াজ শরিফের দিকে থাকলেও নওয়াজের দীর্ঘ নির্বাসনে থাকা এবং ওই সময় মিলিটারিদের সঙ্গে দূরত্ব থাকার কারণে আর্মি সেখানে আরেকটি ঝুলন্ত পার্লামেন্ট উপহার দিচ্ছে এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে। নওয়াজ শরিফকে সমর্থন দেওয়ার পরও নির্বাচনে তার দল সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় সামরিকতন্ত্র এখন তাদের পরিকল্পনা বি কার্যকর করতে যাচ্ছে এটাও সহজেই বোঝা যায়। এদিকে পাকিস্তান অবজার্ভারে প্রকাশিত সেনা প্রধানের মন্তব্যকে উল্লেখ করা যায়-তিনি বলেছেন, স্থিতিশীলতার জন্য একটি শক্তিশালী সরকারের প্রয়োজন। প্রশ্ন হচ্ছে, শক্তিশালী সরকারের জন্য তো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের প্রয়োজন আছে। সেই অবস্থা কি নির্বাচন মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব হয়েছে? আর এরজন্য ইশারাটা যে কার দিকে যাচ্ছে তাও অস্পষ্ট নয়। পিটিআই নেতা ব্যারিস্টার গোহার খান দাবি করেছেন তারা নির্বাচনে ১৭০ আসনে জয়ী হয়েছেন, কারচুপি মাধ্যমে তাদের বিজয়ীদের পরাজয় দেখানো হয়েছে। যাতে পিটিআই ক্ষমতায় যেতে না পারে। কিংবা গেলেও দ্রুত সময়ের মধ্যেই যাতে আরেকটি খেলা খেলানো যায়।
তবে এই লেখা প্রকাশের আগেই হয়তো নির্বাচনের ফল ঘোষণা সম্পূর্ণ হয়ে যেতে পারে। নির্ধারণ হয়ে যেতে পারে কোন দল কিংবা কোয়ালিশন আগামীতে সরকার গঠন করবে। এটা যেমন অনেকটা স্পষ্ট অন্যদিকে এটা আরও স্পষ্ট পাকিস্তানে যেই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদের সরকারে স্থায়িত্বকাল নির্ভর করে দেশটির সেনাবাহিনীর মর্জির ওপর।
এরমধ্যে পাকিস্তানের সংসদে সেনাসমর্থক মুসলিম লীগ নওয়াজ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় পাকিস্তানের পার্লামেন্ট যে ক্ষণস্থায়ী হবে তা নিশ্চিত হয়ে গেছে। সেখানে পিপিপি এবং এমকিউএম এর মতো দলগুলো বিরোধী শিবিরে স্থান পাবে এটা অনুমান হচ্ছে। সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের ভাষ্য হচ্ছে-এমন হলে পাকিস্তান নতুন সরকারের আয়ু ৬/৭ মাসের বেশি হবে না। অর্থাৎ ইমরান খান, নওয়াজ শরিফ যেভাবে ক্ষমতা থেকে অতীতে বিদায় হয়েছেন আগামী সরকারকেও একই পথে হাঁটতে হবে। সেক্ষেত্রে মিলিটারি পক্ষ নওয়াজ শরিফকে যতই সমর্থন করুক না কেন, পরিণতি এর বাইরে হওয়ার সম্ভাবনা কম।
অন্যদিকে ইমরান খানের পিটিআই থেকে স্বতন্ত্র পরিচয়ে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে তৈরি হয়েছে বড় রকমের সন্দেহ। তাদের দলে ভিরিয়ে নেয়ার প্রতিযোগিতার আভাস পাওয়া গেছে ইতোমধ্যে। মোটা অংকের টাকার খেলা হতে যাচ্ছে কয়েকদিনের মধ্যে-এমন আভাসও পাওয়া যাচ্ছে।
স্বতন্ত্র হিসেবে বিজয়ীরা এক থাকলে হয় তো ইমরান খানের দল সরকার গঠনের উদ্যোগ নেবে,অন্যদিকে নওয়াজ শরিফের দল সব বিজয়ীদের আহ্বান জানিয়েছেন সবাই মিলে সরকার গঠনের জন্য। নওয়াজ শরিফের এই আহ্বান যে ইমরান খান মানবেন না এটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে ইমরান খানকে পিপলস পার্টিসহ দুয়েকটি ক্ষুদ্র দলকে টানতে হবে। এটাও কতটা সুদুরপ্রসারি হবে তাও বলা যাচ্ছে না।
তারপরও রাজনীতি যদি রাজনীতিবিদদের মাধ্যমেই চলতে পারে তাহলে সেখানে জোড়াতালি দিয়ে একটি সরকার গঠন সম্ভব হবে। কিন্তু এটা হবে স্বল্পস্থায়ী ভঙ্গুর কাঠামোর তাও নিশ্চিত। একটা নির্বাচন মাধ্যমে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিবর্তন আসার সুযোগ থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে তারা তাদের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না এটাই চরম সত্য। আর সেই খেলার আড়ালে যারা সূত্রধার হিসেবে কাজ করছে-তারা কিন্তু তাদের ছক অনুযায়ীই বিজয়ী হয়েছে। শুধু সেখানে পরাজিত হয়েছে গণতান্ত্রিক রাজনীতি। যা কিনা তাদের জন্মকাল থেকেই তারা বয়ে চলেছেন।
লেখক-সাংবাদিক,শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়