শব্দদূষণে নাকাল ঢাকাবাসী, আইন প্রয়োগ ঢিমেতালে

0
20

প্রতিদিনের ডেস্ক
বিশ্বের অন্যতম অ-টেকসই মেগাসিটিগুলোর একটি রাজধানী ঢাকা। প্রতিনিয়ত বাড়ছে এর জনসংখ্যা। ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি জনসংখ্যার এ নগরীতে যেন সমস্যারও অন্ত নেই। যানজট, জলাবদ্ধতা, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণে নাকাল রাজধানীর বাসিন্দারা। এ অবস্থার মধ্যে দিন দিন ছাড়িয়ে যাচ্ছে ঢাকার শব্দদূষণের মাত্রা। শহরের মানুষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শব্দদূষণের মাত্রাও। ক্রমবর্ধমান যানবাহনে অহেতুক হর্ন, যত্রতত্র সাউন্ড বক্স, মাইকের মাধ্যমে উচ্চশব্দ সৃষ্টি হওয়ায় মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। এ দূষণ রোধে নেই আইনের কার্যকর প্রয়োগ। মানুষের সচেতনতারও প্রবল অভাব লক্ষ্য করা গেছে।
রাজধানীতে মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণে দিন দিন শ্রবণশক্তি হারাচ্ছে নগরীর বাসিন্দারা। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীসহ সব ধরনের মানুষ শব্দদূষণের ভুক্তভোগী। শিশু এবং বয়স্ক ও রোগীদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব প্রকট হয়ে উঠছে। এমনকি শব্দদূষেণের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না ট্রাফিক পুলিশও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শব্দদূষণের কারণে তাদের কানে সমস্যা হয়। দীর্ঘদিন সড়কে কাজ করতে গেলে পেটের নানাবিধ সমস্যাও হয়, মেজাজ খিটখিটে হয়, অতিরিক্ত শব্দের কারণে বাসায় গিয়েও স্বাভাবিক কথাবার্তা বলা সম্ভব হয় না।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণায় শব্দদূষণের বিভিন্ন উৎস উঠে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে গাড়ির হর্ন, নির্মাণকাজ, মাইকের ব্যবহার, শিল্প কারখানা ও ইনডোর (বাসাবাড়ির কাজ, টাইলস কাটা ও ড্রিল মেশিনের শব্দ)।
শব্দদূষণ বিধিমালা-২০০৬ অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময় ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা রয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে।
এই আইনে শাস্তি হিসেবে বলা আছে, আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এ আইনের তেমন প্রয়োগ দেখা যায় না। ক্যাপসের গবেষণায় দেখা গেছে, সব স্থানেই শব্দের তীব্রতা প্রায় একই রকম। আইনের মান্যতায় সাজার বিধান থাকলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না।
শব্দদূষণ নিয়ে ক্যাপসের সর্বশেষ গবেষণা অনুযায়ী, ক্যাপস ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত এক বছর ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের শব্দের তথ্য-উপাত্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংগ্রহ করে। সংস্থাটির গবেষণা বলছে, ১০টি স্থানের নীরব এলাকায় ৯৬.৭ শতাংশ সময় আদর্শ মান (৫০ ডেসিবেল) অতিক্রম করেছে, আবাসিক এলাকায় ৯১.২ শতাংশ সময় আদর্শ মান (৫৫ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে, মিশ্র এলাকায় ৮৩.২ শতাংশ সময় আদর্শ মান (৬০ ডেসিবেল) অতিক্রম করেছে, বাণিজ্যিক এলাকায় ৬১ শতাংশ সময় আদর্শ মান (৭০ ডেসিবেল) অতিক্রম করেছে এবং শিল্প এলাকায় ১৮.২ শতাংশ সময় আদর্শ মান (৭৫ ডেসিবেল) অতিক্রম করেছে। সমগ্র ঢাকা শহরের ১০টি স্থানেই ৮২ শতাংশ সময় ৬০ ডেসিবেলের ওপরে শব্দ পাওয়া গেছে।
শুধু শব্দদূষণ আইন নয়, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ সালের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করা সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ তে গাড়ির লাইসেন্স থেকে শুরু করে রেজিস্ট্রেশন কীভাবে হবে- প্রতিটি বিষয় আলাদা আলাদা করে বলা আছে। চালক কখন হর্ন বাজাবেন, কখন বাজাবেন না তাও উল্লেখ করা আছে, যা অনেক জরুরি আইন। কিন্তু রাজধানীসহ দেশের জেলা শহরগুলোতে এ আইনের বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্টের হালনাগাদ তথ্য থেকে জানা যায়, গত বছরের ১৪ অক্টোবরের পর থেকে চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকার কোনো স্থানে শব্দদূষণের দায়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়নি। এর আগে ১৩ অক্টোবর ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ৪৩ যানবাহন থেকে ৫২ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করা হয় এবং ১২টি হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ করা হয়। এরপর গত তিন মাসে ঢাকা শহরে শব্দদূষণের দায়ে কোনো মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং এনফোর্সমেন্ট শাখার উপ-পরিচালক সৈয়দ আহম্মদ কবির বলেন, ‘গত ডিসেম্বর মাসে নির্বাচনের কারণে মোবাইল কোর্ট চালাতে পারিনি। পরিবেশ, বায়ু ও সব ধরনের দূষণ নিয়ন্ত্রণে জানুয়ারি মাসে আমাদের ১০০ দিনের পরিকল্পনার কারণে সম্ভব হয়নি। এই মাস থেকে আবার শুরু করবো। আসলে মোবাইল কোর্ট করেও শব্দদূষণ কমানো যাচ্ছে না। কারণ মানুষ সচেতন হচ্ছে না, কেউ আইন মানছে না। আমরা হয়তো রাস্তায় দূষণের অপরাধে একটা যানবাহনকে জরিমানা করি, কিন্তু এর মধ্যেই আরও ১০টি গাড়ি চলে যায়।’
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘শব্দদূষণ কমাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে গাড়ির হর্ন দিলে জরিমানার ব্যবস্থা থাকলেও বাংলাদেশের সেই পরিস্থিতি নেই। এখানে আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। মানুষকে সচেতন হতে হবে এবং যথাযথ আইন তৈরি করে এর জোরালো বাস্তবায়ন করতে হবে।’
শব্দ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ঢাকার শব্দদূষণের মাত্রা গ্রহণযোগ্য মাত্রার দ্বিগুণের বেশি হওয়ার কারণে মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। কানে কম শোনা ছাড়া ডায়াবেটিস এবং হার্ট সংক্রান্ত জটিলতা বেড়েছে। শিশু, গর্ভবতী নারী ও বয়স্ক অসুস্থ মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’
তারা বলেন, ‘১২০ ডেসিবেল শব্দ সঙ্গে সঙ্গেই কান নষ্ট করে দিতে পারে। প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে ৮৫ ডেসিবেল শব্দ যদি কোনো ব্যক্তির কানে প্রবেশ করে তাহলে ধীরে ধীরে তার শ্রবণশক্তি নষ্ট হবে।’
এ বিষয়ে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘নির্মাণকাজ থেকে শুরু করে ইনডোরে টাইলস ও ড্রিলিংয়ের সময় শব্দদূষণ হয়। শব্দদূষণের অনেক ক্ষতিকর প্রভাব মানুষ জানেই না। বিশেষ করে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি তো আছেই, শহরে উদ্ভিদের বংশ বিস্তারও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। গাছ-গাছালির পরাগায়ন হচ্ছে না। এতে শস্যের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। রাস্তার পাশে ফেরিওয়ালা থেকে শুরু করে যারাই রাস্তায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা থাকছেন, তারা অনেক বেশি ক্ষতির সন্মুখীন হচ্ছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘শব্দদূষণ রোধে আমাদের যে দুটি আইন রয়েছে সেটি ভালো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এছাড়া আইন অনুযায়ী স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, মসজিদ এলাকায় ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা আছে। আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী পুরো ঢাকা শহরই নীরব এলাকা। কোথাও হর্ন দেওয়া যাবে না। আইন প্রয়োগ করতে গেলে এটা একটা বড় সীমাবদ্ধতা।’
এই পরিবেশ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘যেহেতু শব্দদূষণের অন্যতম উৎস হলো হর্ন। এটি বন্ধ করতে পারলেই ঢাকা শহরের ৬০ শতাংশ শব্দদূষণ কমে যাবে। কিন্তু এটি বন্ধ করার জন্য আইনগত যে ভিত্তি রয়েছে সেটি দুর্বল।’
ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ এর সিনিয়র প্রজেক্ট ম্যানেজার জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আমরা যখন গবেষণা করেছি, দেখেছি শহরের বিভিন্ন জায়গায় নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে দু-তিনগুণ শব্দদূষণ হয়েছে। এখনো দূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রজেক্ট চলছে, কিন্তু তারা যে এলাকা চিহ্নিত করেছে ওই এলাকায় দূষণ এখনো আগের মতোই আছে।’
শব্দদূষণ আইনের সংস্কার প্রয়োজন মনে করে তিনি বলেন, ‘আমরা সবসময় দাবি জানিয়ে আসছি শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশকে দায়িত্ব দেওয়া হোক। তারা সড়কে দায়িত্ব পালন করে। তাহলে তারা নিয়মিত জরিমানা করতে পারবে। এতে কিছুটা হলেও দূষণ কমবে। এক্ষেত্রে শব্দদূষণ আইন ২০০৬ সংশোধন দরকার।’
এ বিষয়ে জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের (ইএনটি) সহযোগী অধ্যাপক ডা. হুমায়রা বিনতে আসাদ বলেন, ‘শব্দদূষণ এখন একটি সামাজিক সমস্যা। এমন কোনো রোগ নেই যেখানে শব্দদূষণের প্রভাব থাকে না। এখানে বধির হওয়া থেকে শুরু করে মানসিক চাপ, হৃদরোগ, মাথাব্যথা, স্মরণশক্তি হ্রাস ও স্নায়ুবিক সমস্যা হয়। এছাড়া গর্ভবতী নারীরা যদি দূষণের শিকার হন, তাদের বাচ্চাও ঝুঁকি নিয়ে জন্মাতে পারে।’
ডা. হুমায়রা আরও বলেন, ‘শব্দদূষণ রোধে মানুষের সচেতনতা অনেক বেশি জরুরি। প্রয়োজনের বাইরে হর্ন বাজানো যাবে না, পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় মাইক ও উচ্চ আওয়াজ থেকে দূরে থাকতে হবে। এখন দেখা যাচ্ছে তরুণ-তরুণীরা সারাক্ষণ হেডফোন কানে লাগিয়ে রাখেন, এটাও ক্ষতিকর।’
শিশু, শিক্ষার্থী, বয়স্ক, রোগী ও পথচারীদের মতো সড়কে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরাও শব্দদূষণের ভুক্তভোগী। তীব্র শব্দদূষণের মধ্যেই প্রতিদিন সড়কে দায়িত্ব পালন করতে হয় তাদের। এতে শ্রবণশক্তি হ্রাস পাওয়াসহ নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তাদের।
এ বিষয়ে ট্রাফিক রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘আমাদের অনেক সদস্য শেষ বয়সে এসে অনেক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কেউ কানে শুনছেন না, কেউ বা মস্তিষ্কের সমস্যায় ভুগছেন, যেগুলো খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না। অনেকেই আইন সংস্কারের কথা বলেছেন। এটা হলে খুবই ভালো হবে। এক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশের কাছে যদি শব্দ মাপার যন্ত্র থাকে তারা আইন অনুযায়ী মামলা করতে পারবে।’