কালীগঞ্জে প্লাস্টিকের দাপটে বাঁশ ও বেত শিল্পের দুর্দিন

0
11

সোহাগ আলী, কালীগঞ্জ
প্লাস্টিকের তৈরি আসবাবপত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বাঁশ ও বেত শিল্পের চাহিদা কমছে। ফলে পাপ্লা দিয়ে বাড়ছে প্লাস্টিকের শো-রুমের সংখ্যা এবং কমে যাচ্ছে বাঁশ ও বেত শিল্পের সরঞ্জামাদির দোকান। ফলে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশার দিকে ছুটছেন অনেক বাঁশ ও বেতশিল্প কারিগররা। তবে হাতে গোণা কিছু কারিগর এখনও পৈর্তৃক পেশাকে ধরে রেখেছেন। ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের বাঁশ ও বেত শিল্পের কারিগর ও ব্যবসায়ীরা দুলাল মিয়া জানান, আগে শহরে বাঁশ ও বেতের তৈরি পণ্যের ১৫ থেকে ১৬টি দোকান ছিল। কিন্তু এখন দোকান মাত্র ৫/৬টি। বেচাবিক্রি নাই বললেই চলে। দুলাল মিয়া আর বলেন. আমি বাঁশ ও বেতের শিল্পের আসবাবপাত্র দিয়ে ঘর সাজিয়েছি। কিন্তু বাঁশে ঘুণ ধরে ঘর নষ্ট হয়। এখন অল্প মূল্যে প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবিল কিনেছি। ইদানিং প্লাস্টিকের আসবাবপত্র গুলো বিভিন্ন ডিজাইনে তৈরি করায় দেখতেও ভালো লাগছে। যে কারনে আমি নিজে ও আমার ছেলে প্লাষ্টিকের দোকান করে ব্যবসা করছি।বাঁশ ও বেত শিল্পের দূরাবস্থার জন্যে এখানে কারিগর আছে কিন্তু তাদের তেমন বিক্রি হয় না। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে না কেউ। এক সময় কুলা, ডালা, সরপোস ব্যবহার ছিল ব্যাপক হাবে। এখন এগুলো প্লাস্টিকের ব্যবহার করছে বেশি। এখন এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। জনসাধারণকে প্লাস্টিক বর্জন করে দেশি জিনিস নিতে হবে। প্লাস্টিক তো মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে। কিন্তু এখন এটাও একটা শিল্প হয়েছে।’এক সময় কালীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ঘরে ঘরে তৈরি হতো নিত্য প্রয়োজনীয় বাঁশ ও বেতের হরেক রকম পণ্য সামগ্রী। যার মধ্যে ছিল কুলা, ধান রাখার জন্য বাঁশের চাটাই, হাঁস-মুরগি রাখার খাঁচা, বিভিন্ন ঢাকনা, চালনি, ঘাস কাটার খাঁচা, বসার মোড়া, বেতের ধামা, চেয়ার, টেবিল, দোলনা, পাখা, ডালা, ধান সংরক্ষণে রাখার বেতের মাচা ইত্যাদি। অনেকে আবার এসব বাঁশ ও বেতের জিনিস বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এ ছাড়াও অনেক দরিদ্র পরিবারের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন ছিল এই বাঁশ ও বেতের পণ্য সামগ্রী। কিন্তু বর্তমানে মানুষ এসব পণ্য ব্যবহার না করায় হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প। সেইসঙ্গে বিপাকে পড়েছে এসব পণ্য যারা বানিয়ে বাজারে বিক্রি করে চলত। কালীগঞ্জ থানা পাড়ার এক বৃদ্ধ বাঁশের বেত দিয়ে খাঁচা তৈরি করতো। তিনি জানান, আগেও তিনি বাঁশ ও বেত দিয়ে খাঁচা, কুলা, মোড়া, বই রাখার তাক ও ঝুড়িসহ বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র তৈরি করে বাজারে বিক্রি করতেন। কিন্তু এখন প্লাস্টিকের কদর বাড়ায় এসব বাঁশ-বেতের জিনিস আর কেউ কিনতে চায় না। তাই এসব আর বানায় না। এই এলাকার প্রায় অনেক মানুষ আগে এই কাজ করে সংসার চালাত। বর্তমানে বাজারে প্লাস্টিক পণ্য মানুষ বেশি কিনে তাই আমাদের পণ্য আর কেউ কিনতে চায় না। এই কারণেই সবাই প্রায় তাদের বাপ দাদার পেশা ছেড়ে দিয়েছে। তা ছাড়া বাঁশের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব কুঠির শিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে। আর এসব পণ্য হারিয়ে গেলে একদিকে যেমন হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য অন্য দিকে বেকার হয়ে যাচ্ছে হাজারো পরিবার। সরকারি ভাবে কোনো সুযোগ সুবিধা পেলে আবারও ফিরে আসতে পারবে নিজস্ব শিল্পে। বৃদ্ধি পাবে গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য বাঁশ ও বেতের তৈরি হস্ত ও কুঠির শিল্পের কাজ এমনটাই সবার আশা বলে জানান তিনি। ঝিনাইদহ কালীগঞ্জে প্লাস্টিকের ভিড়ে হারাতে বসেছে বাঙালি সংস্কৃতির একটি বড় অংশ ঐতিহ্যবাহী বাশঁ ও বেত শিল্প। এক সময়ে গ্রামীন জনপদের মানুষেরা বাঁশ ও বেত দিয়ে গৃহস্থালী ও ব্যবসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন জিনিস পত্র তৈরি করতেন। এসব আসবাব পত্রের কদরও ছিল আলাদা। গ্রামের ঘরে ঘরে এই শিল্পের দেখা মিললে এখন সেখানে জায়গা করে নিয়েছে প্লাস্টিক পণ্য। ফলে দুর্দিনে মানবেতর জীবন কাটছে কারিগরদের। গ্রামীন জনপদে বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি হতো গৃহস্থালী ও সৌখিন পণ্য সামগ্রী। আর বাসা-বাড়িতে ব্যবহার করা হতো বাঁশ ও বেতের তৈরি আসবাবপত্র। বাড়ির কাছের ঝাড় থেকে তরতাজা বাঁশ ও বেত কেটে গৃহিণীরা তৈরি করতেন হরেক রকম পণ্য। এসব বিক্রি করেই চলতো তাদের জীবন। তবে তা ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে।কারগিররা বলছেন, এখন দুস্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে এই শিল্পের কাঁচামাল বাঁশ ও বেতে। অন্যদিকে মেলামাইন, সিলভার ও প্লাস্টিক জাতীয় হালকা সামগ্রী নাগরিক জীবনে গ্রামীন হস্তশিল্পের পণ্যকে হটিয়ে দিয়েছে। আগে বাঁশ ও বেত শিল্পের কাজ দেখা গেলেও এখন খুব একটা দেখা যায় না। এছাড়া প্রতিনিয়ত জিনিসপত্রের মূল্য যেভাবে বাড়ছে সেইসাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না এই শিল্পের বিভিন্ন পণ্যের দাম। যার কারণে টিকে থাকতে কারিগররা হিমশিম খাচ্ছেন।বর্তমানে একটি বাঁশ ৪৫০থেকে ৬০০ টাকায় কিনতে হয়। ডালি প্রতিটির খরচ ২০০টাকা আর বিক্রি ২৫০ টাকা। বড় খাঁচি প্রতিটির খরচ ৬০০ টাকা। যা বিক্রি হয় ৭০০ টাকা। কুলা প্রতিটির খরচ ১৫০ টাকা, যা বিক্রি করতে হচ্ছে ২০০থেকে ২৫০টাকা।হাতেগোনা কিছু সংখ্যক পরিবার বেত শিল্পকে আঁকড়ে ধরে আছে। অনেকেই এই পেশা ছেড়ে অন্য কাজে গেলেও অনেকেই বাপ-দাদার এই পেশা ছাড়তে পারেনি। গ্রামগঞ্জে ঘোরাফেরা করে এই পণ্য বিক্রি করতে হয়। কিছু সৌখিন মানুষ এখনো এই পণ্য কিনেন। সারা দিনে যা বিক্রি হয় তা দিয়ে সংসারের জন্য বাজার করে কোনোমতে টিকে আছেন তারা।বিশেষ করে বেতের দাম বেশি হওয়ায় এবং সামগ্রীক খরচ বেড়ে যাওয়ায় একদিকে সঙ্কটে পড়েছেন কারিগররা। অপরদিকে আর এ সঙ্কটের কারণে মানুষ হারাতে বসেছে প্রাচীন ঐতিহ্য।