বয়সের ভারে ন্যুব্জ শরীর, চোখের জলে ভিজলো সন্তানের কবর

0
24

প্রতিদিনের ডেস্ক
সন্তানের মৃত্যুর চেয়ে বড় কোনো বেদনার ভার পৃথিবীতে আর নেই। যে কোনো বাবা-মা সন্তানের মৃত্যুতে নিজেরা বেঁচে থেকেও দুনিয়াতে নরকযন্ত্রণা ভোগ করেন। তাদের কাছে জীবন হয়ে ওঠে অর্থহীন, যেন রাত্রির বিভীষিকাময় অন্ধকার। ঠিক ১৫ বছর আগে দেশের ইতিহাসে নৃশংসতম পিলখানা হত্যাকাণ্ড বহু বাবা-মাকে করেছে সন্তানহারা। সেইসব বাবা-মায়ের চোখের জল আজও শুকায়নি। দুঃসহ সেই স্মৃতি এখনো তাদের তাড়িত করে অহর্নিশ। মফিজুল ইসলাম সরকার ও মমিনুর নেসা সরকার তেমনই অভাগা বাবা-মা। যারা ১৫ বছর আগে পিলখানায় নির্মম হত্যাকাণ্ডে হারিয়েছিলেন আদরের সন্তান মেজর মোহাম্মদ মুমিনুল ইসলাম সরকারকে।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিডিআরের (বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি) সদরদপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনের প্রাণহানি হয়েছিল। যা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আলোচনা ও চর্চায় আসে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। নারকীয় সেই হত্যাকাণ্ডের ১৫ বছর পূর্ণ হলো। তবে এখনো স্বজন হারানোর শোকে ম্যুহমান অনেক পরিবার। তাদের অনেকে যেমন সন্তানহারা, অনেকেই হারিয়েছেন স্বামী, বাবা অথবা স্বজন।
পিলখানায় নির্মম হত্যাকাণ্ডে ছেলে হারানোর বেদনা এখনো প্রতিনিয়ত কাঁদায় নিহত মেজর মোহাম্মদ মুমিনুল ইসলাম সরকারের বাবা-মাকে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া দুজনেই গত ১৫ বছর ধরে একসঙ্গে ছেলের কবরের সামনে বসে চোখের পানি ফেলেন। নীরবে অঝোরে কাঁদেন। সন্তানহারা এই বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কান্না দেখে আত্মীয়-পরিজন, সেনাসদস্য, এমনকি গণমাধ্যমকর্মীদেরও চোখ ছলছল হয়ে ওঠে। যেন তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেন সবাই।
রাজধানীর বনানী সামরিক কবরস্থানে প্রবেশ করে বাম দিকের শেষ সীমানার কবরটি মেজর মোহাম্মদ মুমিনুল ইসলাম সরকারের। রোববার (২৫ ফেব্রুয়ারি) ছেলের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন বৃদ্ধ বাবা মফিজুল ইসলাম সরকার। প্রথমে চাপা কান্না পরে আর্তনাদ। বাবার এমন অশ্রুপাতে যেন ভিজে যাচ্ছিল সন্তানের কবরের মাটি-ঘাস। অপলক চোখে তিনি তাকিয়ে ছিলেন ছেলের কবরের নামফলকের দিকে।
মফিজুলের সঙ্গে সেখানে ছিলেন তার স্ত্রী মমিনুর নেসা সরকারও। তিনিও শোকে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ছেলের কবরের পাশে। তার চোখ দিয়েও ঝরছিল শোকের অঝোর ধারা। হাউমাউ করে কেঁদেই যাচ্ছিলেন। একটা চাপা কষ্ট, একটা শূন্যতা, সন্তানকে ছুঁয়ে দেখতে না পারার অসহায় আর্তি বৃদ্ধ এ দম্পতি বয়ে বেড়াচ্ছেন গত ১৫ বছর ধরে।
সেই চাপা কষ্ট ও বেদনা নিয়ে এবারও তারা হত্যাকাণ্ডের ১৫ বছর পূর্ণ হওয়ার দিনে ছুটে এসেছেন বনানীতে সন্তানের কবরের পাশে। কখনো চিৎকার করে আবার কখনো নীরবে কাঁদছিলেন এই বাবা-মা। পাশে থাকা স্বজনরা বারবার নানা কথার সান্ত্বনায় থামানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছিলেন। তাদের কান্না যেন কিছুতেই থামছিল না। বাবা-মায়ের চোখের জল যেন শোকের বৃষ্টি হয়ে নেমেছিল সন্তানের কবরের মাটি ও ঘাসে।
৮৬ বছর বয়সী মফিজুল ইসলাম সরকার এখন বয়সের ভারে অনেকটাই ন্যুব্জ। দীর্ঘ সময় পর কান্না কিছুটা থামলে তার সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে যান । কথা বলতে বলতে পরক্ষণেই ভিজে উঠছিল সন্তানহারা এই পিতার স্মৃতিকাতর চোখের পাতা।
মফিজুল ইসলাম সরকার বলেন, আমার আট সন্তানের মধ্যে মুমিনুল ছিল সবচেয়ে মেধাবী। ছেলে সেনাবাহিনীতে গিয়েছিল। কেউ কখনো ভাবতে পারিনি ছেলেকে এভাবে হারাতে হবে। ডিকশনারির প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত সব মুখস্থ ছিল তার। সহকর্মীরা বলতো- স্যার থাকলে ডিকশিনারির পাতা উল্টাতে হয় না। আমাদের এলাকার ছোট থেকে বড় এমন কেউ নেই যে মেজর মুমিনুলের নাম শুনলে আফসোস করে না।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ১৫ বছরেও বিচারকাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। এ নিয়ে জানতে চাইলে মফিজুল ইসলাম সরকারের কথায় শুধু আক্ষেপই ঝরে। তিনি বলেন, এই চৈত্রে আমার বয়স ৮৬ বছর পূর্ণ হবে। ছেলের হত্যাকাণ্ডের বিচার দেখে যেতে পারবো কি না, আল্লাহই ভালো জানেন। আমি জীবদ্দশায় বিচারকার্য দেখে যেতে চাই, এটাই এখন শেষ ইচ্ছা আমার।
পাশেই দাঁড়ানো মেজর মুমিনুলের মা মমিনুর নেসা সরকার বলেন, এদিনের কথা মুখে বলার মতো কিছু নেই, বুকটা চিরে দেখাতে পারলে সবাই বুঝতো একজন সন্তানহারা মায়ের জীবন কতটা কষ্টের। আমার সন্তান কবরে শুয়ে আমাকে ডাকছে। কিন্তু আমি শুনতে পাচ্ছি না। ও আমাকে আম্মা আম্মা বলে ডাকছে…।
মেজর মুমিনুলের কবরের পাশেই মেজর এস এম মামুনুর রহমানের কবর। তিনিও পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নিহত হন। মেজর মামুনুরের মা আম্বিয়া খানম ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বারবার চোখ মুছছিলেন। তার সঙ্গে কথা হলে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, এতগুলো অফিসারকে একেবারে মেরে ফেললো আর সেই হত্যার বিচার করতে এত বছর সময় লেগে যাচ্ছে? বিচার হলেইবা আমার কী লাভ! সন্তানকে কি আমি ফিরে পাবো? আমার তো পুত্রশোকে পুরো জীবনটাই শেষ। ওর বাবাও ছেলের কথা ভাবতে ভাবতে হার্টের রোগী হয়ে গেছে। আমার পরিবার, আমার সংসার ধ্বংসের মুখে।সেখানে অন্য একটি কববের সামনে আবেগাপ্লুত অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ফাবিয়া বুশরা। তিনি পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নিহত শহীদ লে. কর্নেল লুৎফর রহমানের কন্যা।
বাবার কবরে শ্রদ্ধা জানাতে এসে ফাবিয়া বুশরা বলেন, এ ঘটনায় জড়িত অনেককে গ্রেফতার করা হলেও বিচারের রায় এখনো কার্যকর করা হয়নি। এখন পর্যন্ত কারও ফাঁসি হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। এত বড় একটি হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পেছনে অনেক শক্তি থাকার কথা। সেই শক্তিগুলো আসলে সামনে আসেনি। যারা মাঠে বসে গুলি চালিয়েছিল তারা কার মদতপুষ্ট হয়ে এ কাজ করেছে, আমরা জানতে চাই। আমরা চিনতে চাই তারা কারা…। জানি না আমাদের জীবদ্দশায় এসব সত্য জানতে পারবো কি না। তবে একটাই চাওয়া, অন্তত বেঁচে থাকতে থাকতে যেন এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দেখে যেতে পারি। যেন জানতে পারি- হত্যাকাণ্ডের পেছনের শক্তি কারা ছিল।
লে. কর্নেল লুৎফর রহমানের মেয়ে আরও বলেন, আমরা মনে করি পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ব্যর্থতা রয়েছে। কারণ, এ হত্যাকাণ্ডটি অনেকদিনের পরিকল্পনার পর ঘটানো হয়েছে। কিন্তু এমন একটি ঘটনা ঘটানো হবে সংশ্লিষ্টরা তা হয়তো বুঝতে পারেননি, এটা তাদের ব্যর্থতা। আমাদের জন্য দুঃখের বিষয় হলো, ১৫ বছরেও জানতে পারলাম না ঘটনার নেপথ্যে কারা ছিল। আমরা আশা করি প্রকৃত সত্যটা অবশ্যই বের হয়ে আসবে।
পিলখানা ট্রাজেডিতে নিহত মেজর মোস্তফা আসাদুজ্জামানের ভায়রা আসলাম সেরনিয়াবাত এসেছিলেন কবরে শ্রদ্ধা জানাতে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ফাঁসি হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
আসলাম সেরনিয়াবাত বলেন, বিচারকার্য বিলম্ব হওয়ায় শাহাদতবরণকারী শহীদদের প্রতি সঠিক সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে না, তাদের আত্মা কষ্ট পাচ্ছে। ওই সময়ে পিলখানায় বিদ্রোহ চলাকালীন বেশকিছু টেলিভিশন বিদ্রোহীদের ইন্টারভিউ করেছিল। তারা সরাসরি টেলিভশনে কথাও বলেছে। তারা বেশকিছু দাবি তুলে ধরেছিল। তখনকার ভিডিও সাক্ষাৎকারই যথেষ্ট, এরচেয়ে বড় সাক্ষী হয় না। ওই ভিডিও ফুটেজ দেখে হয়তো বিচারকার্য শেষ হবে বলে আশা করি। ন্যায়বিচার হলে নিহতদের পরিবারগুলোতে কিছুটা শান্তি ফিরবে।
২৫ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘সেনা শহীদ দিবস’ করার দাবি জানিয়ে আসলাম সেরনিয়াবাত বলেন, দেশে এত এত দিবস রয়েছে। আর এতগুলো অফিসারকে হত্যা করা হলো; ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘সেনা শহীদ দিবস’ এর মর্যাদা দেওয়া উচিত।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দেশের বিভিন্ন জায়গায় একযোগে তৎকালীন বিডিআর সদস্যরা বিদ্রোহ করেন। সবচেয়ে বেশি নৃশংসতা চালানো হয় ঢাকায় বিডিআর সদর দপ্তরে। এ ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে তৎকালীন বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদও আছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনাকে নৃশংসতম বলে বর্ণনা করা হয়।
নারকীয় এ হত্যাকাণ্ডের ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি কোনো মামলার। এনিয়ে করা দুটি মামলার মধ্যে হত্যা মামলার বিচার আপিল বিভাগে শুনানির জন্য অপেক্ষমাণ। ২০১১ সালে শুরু হওয়া বিস্ফোরক আইনের মামলার বিচার ঢাকার আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।
হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের পর ছয় বছরে সর্বোচ্চ আদালতে শুনানি হয়নি। তবে চলতি বছরের মধ্যে আপিল শুনানি শুরু হতে পারে বলে আশা করছে রাষ্ট্রপক্ষ। আসামিপক্ষের প্রত্যাশা, আপিল বিভাগে বিচারক বাড়িয়ে আলাদা বেঞ্চ গঠন করে দ্রুত শুনানির ব্যবস্থা করা হবে।
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনাক্রম-
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা ২ মিনিট: পিলখানায় দরবার শুরু। দরবারে মোট উপস্থিত ছিলেন দুই হাজার ৫৬০ জন।
৯টা ২৬ মিনিট: ডিজির বক্তব্য চলাকালে মঞ্চের বাম দিকের পেছন থেকে দুজন বিদ্রোহী অতর্কিত মঞ্চে প্রবেশ করেন। এদের একজন ছিলেন সশস্ত্র। বিদ্রোহ শুরু হয়।
৯টা ৩০ মিনিট: ডিজি নিজে প্রধানমন্ত্রী, সেনাপ্রধানসহ অন্যদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে দ্রুত সেনা হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানান।
১০টা ১৫ মিনিট: র‌্যাবের একটি দল পিলখানার ৩, ৪ ও ৫ নম্বর ফটকে পৌঁছায়।
১০টা ৩০ মিনিট: বিদ্রোহীরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে দরবার হলে ঢোকেন এবং কর্মকর্তাদের বের হয়ে আসার নির্দেশ দেন। ওইসময় ডিজিকে বৃত্তাকারে ঘিরে কর্মকর্তারা মঞ্চের পেছন দিক থেকে বের হয়ে আসেন।
আনুমানিক ১০টা ৩৫ মিনিট: ডিজির নেতৃত্বে কর্মকর্তারা এক সারিতে দরবার হল থেকে বের হয়ে মাত্র সিঁড়িতে কয়েক পা দিয়েছেন, তখনই বাইরে দাঁড়ানো মুখ বাঁধা সৈনিকরা ব্রাশফায়ার করে। মুহূর্তে ঢলে পড়েন ডিজিসহ আরও কয়েকজন কর্মকর্তা।
বেলা ১১টা: বিদ্রোহীরা ম্যাগাজিন ভেঙে গুলি-বারুদ সংগ্রহ করেন। এর আগে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে কেন্দ্রীয় অস্ত্রাগার ভেঙে অস্ত্র লুট করেন তারা। ১১টা নাগাদ সেনাবাহিনীর একটি দল ধানমন্ডির মেডিনোভা ক্লিনিকের সামনে অবস্থান নেয়। বিদ্রোহীরা ১৬টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন। বাইরে থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যায়।
দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারের মাধ্যমে পিলখানায় বিদ্রোহীদের প্রতি অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ছাড়া হয়। এসময় হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। হেলিকপ্টারে ছয়টি গুলি লাগে।
১২টা ৩০ মিনিট: ৩ নম্বর ফটকের সামনে বিডিআরের পক্ষে শতাধিক মানুষের একটি মিছিল হয়। এরপর বিদ্রোহীরা প্রায় ২০ মিনিট ধরে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়েন। তারা মাইকে জানান, আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে একা আসতে হবে।
১টা ৩০ মিনিট: আলোচনার মাধ্যমে বিদ্রোহীদের নিরস্ত্রীকরণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সাদা পতাকা নিয়ে ৪ নম্বর ফটকের সামনে যান প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সরকারি দলের হুইপ মির্জা আজম।
বিকেল ৩টা: প্রতিমন্ত্রী নানক, সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপস ও হুইপ মির্জা আজমের সঙ্গে ফটকের সামনে অবস্থানরত বিডিআর বিদ্রোহীরা কথা বলতে রাজি হন। তারা বিদ্রোহীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে রাজি করান।
৩টা ৪০ মিনিট: তারা ১৪ সদস্যের বিডিআর প্রতিনিধিদলকে নিয়ে সরকারি অতিথি ভবন যমুনায় প্রবেশ করেন। যমুনায় তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। তখন যমুনায় তিন বাহিনীর প্রধান, আওয়ামী লীগের নেতা তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত উপস্থিত ছিলেন।
সন্ধ্যা ৬টা: আলোচনা শেষে জাহাঙ্গীর কবির নানক অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, বিডিআর প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনার পর প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহী সদস্যদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন এবং অস্ত্র জমা দিয়ে তাদের ব্যারাকে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
৬টা ৪৫ মিনিট: যমুনা থেকে বিদ্রোহীদের প্রতিনিধিদলকে সঙ্গে নিয়ে নানক ও মির্জা আজম পিলখানায় ফেরেন।
সন্ধ্যা ৭টা: প্রধানমন্ত্রীর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাকে গেজেট আকারে প্রকাশের দাবি করেন এবং আগের মতো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ শুরু করেন জওয়ানরা।
রাত ৮টা: ধানমন্ডির হোটেল আম্বালা-ইনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের সঙ্গে বিদ্রোহীদের আরেকটি প্রতিনিধিদলের বৈঠক শুরু। নানক ও মির্জা আজম, পুলিশের আইজি, র‌্যাবের ডিজি, গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও ছিলেন।
এর আগে সন্ধ্যার পর পিলখানায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে কর্মকর্তাদের মরদেহ সরানো শুরু ও পুঁতে ফেলা হয়।
২৫ ফেব্রুয়ারি দিনগত রাত ১টা: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইন প্রতিমন্ত্রী ও আইজিপি পিলখানার ভেতরে যান এবং বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন।
রাত ১টা ৩০ মিনিট: বিদ্রোহীরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে কিছু অস্ত্র সমর্পণ করেন।
২৬ ফেব্রুয়ারি ভোর ৪টা ১০ মিনিট: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আটকে পড়া ১৫ জন জিম্মিকে বের করে আনেন।
সকাল সাড়ে ৯টা: মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও সংসদ সদস্য তাপস বিডিআর সদর দপ্তরের ৪ নম্বর ফটকে উপস্থিত হন।
সকাল ১০টা: যমুনায় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ ও মহাজোটের জ্যেষ্ঠ নেতাদের বৈঠক শুরু।
বেলা ১১টা ৩০ মিনিট: প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত। এরপর তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক।
দুপুর ১টা ৩০ মিনিট: সংসদ সদস্য মাহবুব আরা ও সেগুফতা ইয়াসমিনের নেতৃত্বে আরেকটি প্রতিনিধিদল পিলখানায় যায়। প্রায় এক ঘণ্টা পর তারা তিন সেনা কর্মকর্তার পরিবারের সদস্যদের বের করে আনেন। একই সময়ে হোটেল আম্বালায় মতিয়া চৌধুরী ও এরশাদসহ অন্যদের সঙ্গে বিদ্রোহীদের বৈঠক ভেঙে যায়।
বিদ্রোহীদের দুপুর ২টার মধ্যে সব অস্ত্র জমা দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয় সরকার। পিলখানার মূল ফটকে জওয়ানদের আবার গুলিবর্ষণ।
দুপুর ২টা ৩০ মিনিট: সরকারের ১২ সদস্যের মধ্যস্থতাকারী কমিটি গঠন। আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে এই কমিটি পিলখানায় যায়। কমিটি বিদ্রোহীদের সঙ্গে হোটেল আম্বালায় আবার বৈঠক করে।
টেলিভিশন ও বেতারে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ প্রচার। বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণ করে ব্যারাকে ফিরে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ভাষণের পর বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন।
বিকেল ৪টা: হোটেল আম্বালায় অর্থমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের বৈঠক। এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং নানক ও মির্জা আজম পিলখানার ভেতরে যান।
বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণ শুরু।
সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিট: সমর্পিত অস্ত্র হেফাজতে নিতে পিলখানায় পুলিশের প্রবেশ। রাতে পুলিশ পিলখানায় অবস্থান নেয়।
রাত ৮টা ৩০ মিনিট: পিলখানা থেকে বেরিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণা—পরিস্থিতি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
মামলার রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৮৫ জনের যাবজ্জীবন
২০০৯ সালের বর্বরোচিত এ ঘটনার পর দুটি ফৌজদারি মামলা করা হয়। এরমধ্যে বিস্ফোরক মামলাটির শুনানি এখনো নিম্ন আদালতে বিচারাধীন। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর নিম্ন আদালত হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। ওই রায়ে ৮৫০ আসামির মধ্যে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২৭৮ জনকে খালাস দেন আদালত। রায় ঘোষণার আগেই মারা যান চার আসামি।নিম্ন আদালতের রায়ের বিপরীতে আসামিরা উচ্চ আদালতে যান। শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর ৫৫২ জনকে বিচারের আওতায় এনে বাকি ২৮৩ জনকে খালাস দেন আদালত।
উচ্চ আদালতে শুনানি চলাকালে আরও ১১ জনের মৃত্যু হওয়ায় মোট ৮৩৫ জনের বিরুদ্ধে শুনানি হয় আলোচিত এ মামলায়।
নিম্ন আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ১৫২ জনের মধ্যে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন উচ্চ আদালত। আটজনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও পাঁচজনকে খালাস দেন হাইকোর্ট। এরপর আসামিদের অনেকেই আপিল বিভাগে আপিল করেন, যার শুনানি এখনো শুরু হয়নি। আর বিস্ফোরক মামলাটির বিচার এখনো চলছে নিম্ন আদালতেই।
বিডিআর পুনর্গঠন ও বিজিবি গঠন
পিলখানায় এ বিদ্রোহের ঘটনায় বিডিআরের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে যায়। শুরু হয় বিডিআর পুনর্গঠনের কাজ। বিডিআরের নাম, পোশাক, লোগো ও সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তন করা হয়। জাতীয় সংসদে ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন, ২০১০’ পাস হয়। ওই বছরের ২০ ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ২৩ জানুয়ারি বাহিনীর সদরদপ্তরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) নতুন পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন এবং মনোগ্রাম উন্মোচন করেন। এর মধ্যদিয়ে শুরু হয় এ বাহিনীর নতুন পথচলা।