সাহিত্যশিল্পীরা সার্থক শিল্পমানে, শিল্পসংখ্যায় নয়

0
26

প্রতিদিনের ডেস্ক:
সাহিত্যশিল্পী ও বইয়ের সংখ্যা যেভাবে বেড়েছে, পাঠক সেভাবে বাড়ছে না। ফলে শিল্পী ও শিল্পের নামটা অবিদিতই থেকে যাচ্ছে মানুষের কাছে। এই সাহিত্যশিল্পীর মধ্যে রয়েছেন কবি, অ-কবি কিংবা নামধারী কোনো লেখক। তাঁদের কেউ কেউ মনের খেয়াল-খুশিতেই দুয়েকটা বই প্রকাশ করে থাকেন; আর অনেকেই কিছুটা সাহিত্যিক-নাম অর্জন করার পরও শিল্পমানের দিকে না তাকিয়ে কেবল শিল্পসংখ্যাটা বাড়িয়েই চলেছেন। এতে প্রকৃত সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে হয় না। শিল্পীকে বিখ্যাত হতে গেলে, শিল্পসংখ্যায় বেশি হতে হবে—এমন কোনো যুক্তি থাকার কথা নয়। কেননা স্বল্পসংখ্যক লিখেও খ্যাতিমান সাহিত্যশিল্পীর নজির বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ নয়। মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আবদুল কাদির, আবু ইসহাক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হেলাল হাফিজ প্রমুখ সাহিত্যশিল্পীরা এর দীপ্ত প্রমাণ। ‘সংস্কৃতি-কথা’ বইটি মোতাহের হোসেন চৌধুরী তথা বাংলা সাহিত্যের সম্পদ। সভ্যতা ও সুখ তাঁর অনূদিত বই। অল্প রচনার মাধ্যমেই তিনি মননশীল প্রাবন্ধিক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন—যা দশটি বই দিয়েও হয়তো সম্ভব নয়। কবি-সমালোচক আবদুল কাদির দীর্ঘজীবনে মাত্র দুটো কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন—দিলরুবা (১৯৩৩) ও উত্তর বসন্ত (১৯৬৭)। দিলরুবা বইটি তাঁকে কবি হিসেবে খ্যাতি এনে দিয়েছিল তিরিশের দশকেই। এই কবির কবিতা মৈত্রী, মানুষের সেবা, জয়যাত্রা পাঠ্যবইয়ে থাকার দরুণ স্কুলজীবনেই আমাদের পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। এ ছাড়া তাঁর সমালোচনামূলক গ্রন্থও রয়েছে। আবু ইসহাকের নাম উল্লেখের সাথে সাথেই ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ উপন্যাসটির নাম অকপটে মুখে চলে আসে। মূলত এই এক উপন্যাসই তাঁকে শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকের তালিকায় স্থান করে দিয়েছে। এই লেখকের বইয়ের সংখ্যাও মুষ্টিমেয়। কথাসাহিত্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটা বিশেষ স্থান আছে। তিনি রচনার সংখ্যা বৃদ্ধির ওপর জোর না দিয়ে লেখার গুণগত মানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যাও এককের অঙ্ক ছাড়িয়ে যাবে না। আধুনিক কবি হেলাল হাফিজের মাত্র তিনটি কবিতার বই। বিশেষত ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থটি পাঠকের কাছে বহুল প্রশংসিত। বিস্ময়ের কথা এই যে, বইটির ৩৩টিরও বেশি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। এমনই আরও উদাহরণ দেওয়া যায়, কিন্তু তা বাহুল্য। অনেকেই বলতে পারেন, রবীন্দ্রনাথ কি কম লিখেছেন? তিনি তো বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন। উত্তরে বলা যায়: রবীন্দ্রযুগ আর আমাদের যুগ এক নয়। সেই সময় বাংলা সাহিত্যের গ্রন্থের সংখ্যা ছিল সীমিত। তা ছাড়া রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুলের গগনস্পর্শী প্রতিভার কাছে অন্যদের প্রতিভা ম্রিয়মাণ। রবীন্দ্রনাথ, আল মাহমুদ, মহাদেব সাহা প্রমুখের সাহিত্যকর্ম অনেক—মূলত সেজন্য আমরা তাঁদের স্মরণ করি না; বরং রচনার শিল্পমূল্যের জন্যই তাঁরা সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে সমাদৃত। বাহ্যজগতে একজনের দশটি গাড়ি দেখে অপরজন সমসংখ্যক কেনার জন্য প্রতিযোগিতা করে। কিন্তু শিল্পের জগতে এই সংখ্যার দিকে যদি কোনো শিল্পী নজর দেন কিংবা সংখ্যাটাকেই প্রাধান্য দেন, তা হলে বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়। যেহেতু শিল্পসংখ্যার চেয়ে শিল্পমানের গুরুত্বই বেশি। তাই শিল্পীর খেয়াল রাখা উচিত যে, তার শিল্পটা শিল্পের মতো হচ্ছে কি না। আগের সন্তানের সংখ্যা এককের অঙ্ক ছাড়িয়ে যেত, এ সময়ের স্লোগান: ‘দুটো সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়।’ বাস্তবেও তা-ই হচ্ছে। তা হলে শিল্পের ক্ষেত্রে বইয়ের সংখ্যা বাড়ানো উচিত কোন যুুক্তিতে? কথায় আছে, ক্ষেতের মতোন ক্ষেত একটাই যথেষ্ট কিংবা ছেলের মতোন ছেলে একটাই ভালো। শিল্পের জগতেও তা উপেক্ষা করা চলে না। শিল্পী নিজেও হয়তো জানেন না যে, তাঁর হাত দিয়ে কখন সেরাটা বের হবে। নজরুল ও জসীম কবিজীবনের একেবারে প্রথম দিকের কবিতাকে অতিক্রম করতে পারেননি পরবর্তী সারাজীবন লিখেও—‘বিদ্রোহী’ ও ‘কবর’ কবিতাই এর সাক্ষ্য বহন করছে। মায়ের কাছে দশটি সন্তানের প্রতি সমান মায়া থাকলেও জনসাধারণ তো আর দশ জনকেই ভালোবাসে না। অর্থাৎ যে ছেলেটার চরিত্র, আদব-কায়দা ভালো হয়, তার প্রতিই সমাজের সুনজর থাকে। তেমনই শিল্পীর কাছেও তার সবকটা শিল্পকর্মের প্রতিই সমান দরদ থাকতে পারে কিন্তু সবার কাছে নয়। যে বইটা পাঠকের মনে রেখাপাত করে, পাঠক তা-ই গ্রহণ করবে যুগ থেকে যুগান্তরে। ছোটকালে শুনেছিলাম—কথা কম কাজ বেশি। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও বলা যায়—লিখতে হবে কম বুঝতে হবে বেশি। ফলে লেখাটা যেমন নিটোল ও পরিপুষ্ট হবে; অন্যদিকে যা-তা নামের উটকো বইয়ের ঝামেলা থেকেও মুক্তি পাবে পাঠক। আসল কথা, সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করতে চাইলে ভুরি ভুরি ঢাউস আকৃতির বই নিয়ে হাজির হওয়ার দরকার নেই; বরং শিল্পসমৃদ্ধ দুয়েকটা বই-ই যথেষ্ট। প্রসঙ্গত, কবি আবুল হোসেনের ভাষ্য—‘আগে অনেক লিখতাম। কম লেখার পেছনে আবু সায়ীদ আইয়ুবের সতর্কতা কাজ করেছে। আইয়ুব বলতেন, এত লেখেন কেন? বেশি লিখলে কি লেখা ভালো হয়? আমাকে বললেন, কোনো লেখা কখনো পুনরায় বলবেন না। একবার যা লিখেছেন তা আর লিখবেন না। এই বলে জীবনানন্দ দাশের উদাহরণ দিলেন।’ (কালি ও কলম, ভাদ্র ১৪২৯) মানুষের মেমোরি একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ধারণ করতে সক্ষম। পুরাতন স্মৃতি মুছে তাতে নতুন কিছু যোগ করে। তাই পাঠককেও দোষ দেওয়া চলে না যে, লেখকের সবকটা বইয়ের নাম বলতে পারবে—বইয়ের নাম দূরেই থাকুক, লেখকের নামটাইবা জানে কজনে! অথচ শিল্পী বাঁচতে চান শিল্পের মধ্যে; আর সেই শিল্পটাই যদি মরা থাকে তাহলে শিল্পীকে বাঁচাবে কী করে? শিল্পীরাই শিল্পের স্রষ্টা। একজন সাহিত্যশিল্পীও হয়তো চান যে তার শিল্পটা শিল্পের মতো হোক—কিন্তু হচ্ছে না কেন! শিল্পীর শিল্পজ্ঞানের অভাব, সাহিত্যের ভাষা প্রয়োগে উদাসীনতা, সহজ লেখা, দ্রুত পাঠকপ্রিয়তার আকাঙ্ক্ষা, একজনের মনঃপূত হওয়া, ফরমায়েশি লেখা, শশব্যস্ততা, লেখকের সৃজনীশক্তির অভাব, আরেক সৃষ্টিকর্মে শিল্পীর মন পড়ে থাকা—সর্বোপরি শিল্পের সংখ্যা বাড়ানোর স্পৃহা; এসব দায়ী করা যেতে পারে।লেখাই লেখকের নেশা। লেখালেখি ছাড়া শিল্পী বাঁচবেন কী নিয়ে? আমি লেখালেখির বিরোধিতা করছি না; লেখা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কথাও বলছি না। তবে বই পড়া চাই। অজানা তথ্য ও তত্ত্ব জানা চাই; পরে শিল্পসম্মত প্রকাশ চাই। এই তো সাহিত্য। নতুন প্রজন্মের লেখকদের কথা ভেবে সাহিত্যিক আবুল ফজল আশান্বিত হয়েছিলেন: ‘তাঁরা নিজেরাই ভাষা দেবেন তাঁদের যুগকে। নিশ্চয়ই তা অভিনন্দিত হবে যদি তা হয় সাহিত্য।’ এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, লেখায় যুগের কথা উঠে আসতে হবে এবং সাহিত্য পদবাচ্য হতে হবে। নইলে তা সাহিত্য-বিচারের ধোপে টিকবে না, আর না টিকলে মহাকাল তো ধরে রাখবেই না—এমনকি বর্তমানও নয়।শুরুতেই বলেছি, লেখক-শিল্পী ও বইয়ের সংখ্যা বাড়ছে। যদি এভাবে বাড়তেই থাকে, তা হলে ভবিষ্যৎ-পরিণতিইবা কী হবে! না পাবে সেলফে জায়গা—না পাবে পাঠকের হৃদয়ে-আসন। অতিরিক্ততা কোনো ক্ষেত্রেই সুফল বয়ে আনে না। এমনকি মানবজীবনটাকেও বেশি আশকারা দিলে জীবন থেকে কিছু প্রত্যাশা করা যায় না। আমরা জানি যে, মাতৃস্নেহের কোনো তুলনা নেই; কিন্তু অতি স্নেহ যে সন্তানের জন্য অকল্যাণ ডেকে আনে এ কথায় কেউ দ্বিধাবোধ করেন না নিশ্চয়ই। তাই সাহিত্যের ক্ষেত্রে রচনার শিল্পমান বজায় রাখার পাশাপাশি বইয়ের সংখ্যাও কমিয়ে আনা চাই।