ড. হাসিনা খান: গবেষণায় আলো ছড়ান যিনি

0
24

মৌলি আজাদ
তাকে হয়তো এক নামে আমাদের তরুণ সমাজের অনেকেই চিনবে না। কারণ তিনি ভাইরাল ফিগার নন। তিনি বর্তমান সময়ের হুটহাট করে ওপরে ওঠা কোনো সেটিব্রেটি নন। তিনি একজন বিজ্ঞানী। তিনি বিজ্ঞানের নিরলস সাধক। আমাদের দেশে অধ্যাপক ড. হাসিনা খানের মতো নারীরা হতে পারতেন বহু নারীর আইডল। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। এ প্রজন্মের মেধাবী নারীরাও সস্তা জনপ্রিয়তা আর অর্থের লোভে গভীর বিষয়ে চিন্তা না করে নিজেদের অস্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যস্ত হন। কিন্তু কেন? বোধকরি, বর্তমান অস্থির সময় এজন্য দায়ী। ৮ মার্চের নারী দিবসে, লেখার জন্য খুঁজে ফিরছিলাম এমন একজন মেধাবী নারীকে যিনি সস্তা জনপ্রিয়তার দিকে না ছুটে ডুবে থেকেছেন চিরকাল বিজ্ঞানের গবেষণায়।
চলুন দেখি, সংক্ষেপে অধ্যাপক ড. হাসিনা খানের কাজগুলোর দিকে-
এক.
তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের সর্বপ্রথম চেয়ারপারসন ছিলেন তিনি। তার পরিচয় তিনি একজন সফল গবেষক। তিনি ২০১০ সালে বাংলাদেশের সাড়া জাগানো সাফল্য পাটের ‘জিন নকশা উন্মোচন প্রকল্পের বা জুট জিনোম প্রজেক্টের’ একজন অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা ও উদ্যোক্তা।
দুই.
প্রায় তিন দশক হলো প্রাণরসায়ন ও জিন প্রকৌশল নিয়ে অধ্যাপক হাসিনা খান গবেষণা করছেন। আর এর অর্ধেকটা সময়ই তিনি দিয়েছেন পাটের মলিকিউলার বা আণবিক পর্যায়ের গবেষণায়। তার বাবার ইচ্ছায়ই তিনি গবেষণার ক্ষেত্র হিসেবে পাটকে বেছে নিয়েছেন। ১৯৯৫ সাল থেকে শুরু হয় তার পাট গবেষণা।
তিন.
পাট গবেষণায় সাহায্যের জন্য ‘বাংলাদেশ পাট গবেষণা কেন্দ্র’ তাকে বিশেষভাবে সাহায্য করে। শীতকালেও কী করে পাট জন্মানো যায় তা নিয়ে অবিরাম ভাবতে গিয়ে এমন একটি পাটের জিন নির্ণয় করতে সক্ষম হন হাসিনা খান, যা পাটকে ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে জন্মাতে সাহায্য করে। এছাড়া ছত্রাকরোধী পাট, পাটের জিনোমে মার্কার ডিএনএ নিয়েও প্রচুর গবেষণা করেছেন তিনি। তার গবেষণার ফলে কিছু জিন ও তাদের অণুক্রম নির্ণয় করা সম্ভব হয়।
তিনি ভাবতেন, পাটের সব জিন অর্থাৎ পুরো জিনোমের সিকোয়েন্সিং বা অণুক্রম যদি নির্ণয় করা যেত, তবে পাটকে আরও ভালো করে বোঝার সুযোগ হতো। পাটের জিনোম নিয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী ড. মাকসুদুল আলমের সঙ্গে পরিচয়ের ফলে তার কাজ আরও সহজ হয়ে যায়। অনেকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের স্বপ্ন সফল হয়।
চার.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগ ড. হাসিনা খানের ভালোবাসার এক জায়গা। তিনি বলেন, ‘এই বিভাগের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আমার গবেষণাজীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। বছর দশেক আগে নতুন এ বিভাগের প্রথম চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশের সেরা মেধাবীদের পর্যাপ্ত সুবিধা দিতে পারছি কি না, সে দুশ্চিন্তায় বহু নির্ঘুম রাত পার করেছি। চিঠি টাইপ করা, ক্লাস রুমে চেয়ারের ব্যবস্থা করা-এসব কত কিছুই না করেছি। সহকর্মী ড. জেবা ইসলাম সেরাজ, ড. রফিকুর রহমানের সহযোগিতার কথা এ মুহূর্তে খুব মনে পড়ছে।’
পাঁচ.
ইলিশ মাছ (হিলসা সাদ) আমাদের জাতীয় মাছ এবং এই মাছ আমাদের দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক। বাংলাদেশের জিডিপিতেও ইলিশের অবদান রয়েছে। অধ্যাপক হাসিনা খান আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দলের সাথে গবেষণা করে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে ইলিশের জিনোম আবিষ্কার করেছেন, যা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
ছয়.
জাতীয় জীবপ্রযুক্তি নীতিমালা প্রণয়নে তিনি পরামর্শকের ভূমিকা পালন করেন । দেশ-বিদেশে নামকরা সব জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তার বহু গবেষণাপত্র।
সাত.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগ এবং প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ; সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ডেটাসফট সিস্টেমস বাংলাদেশ লিমিটেডের একঝাঁক তরুণ গবেষকের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘স্বপ্নযাত্রা জুট জিনোম প্রজেক্ট’ দল। এধরনের কাজের জন্য প্রয়োজন হয় প্রচুর অর্থ । ড. হাসিনা খান যে প্রজেক্টের প্রধান তার সাফল্য তো অবশ্যম্ভাবী, তাই সরকার থেকে আর্থিক সাহায্য পেতে সেই টিমের তেমন বেগ পেতে হয়নি ।
আট.
ইউজিসি প্রফেসরশিপ প্রবর্তনের পর দ্বিতীয় নারী গবেষক হিসেবে অধ্যাপক ড. হাসিনা খানকে ইউজিসির প্রফেসর হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। ইউজিসি প্রফেসরশিপ নীতিমালা অনুযায়ী, অবসরপ্রাপ্ত খ্যাতিমান গবেষকদের ইউজিসি প্রফেসরশিপ প্রদান করা হয়।
নারী দিবসে বাংলাদেশের স্বনামধন্য বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. হাসিনা খানকে নিয়ে লেখার কারণ হলো-নতুন প্রজন্মের নারীরা যেন বিজ্ঞান শিক্ষার দিকে আকৃষ্ট হন। তারা যেন সফল গবেষক হন। ড. হাসিনা খানের মতে এখন বাংলাদেশে রয়েছে গবেষণার প্রচুর সুযোগ। গবেষকদের উচিত তাদের কাজের ক্ষেত্র তৈরি করে গবেষণায় পরিপূর্ণ মনোনিবেশ করা।
একজন সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত প্রফেসর সর্বোচ্চ যে সুযোগ সুবিধাপ্রাপ্ত হন ইউজিসি প্রফেসররাও একই সুযোগ সুবিধাপ্রাপ্ত হন। ইউজিসি প্রফেসররা তাদের পছন্দ অনুযায়ী যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অথবা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে সংযুক্ত থেকে গবেষণা পরিচালনা করতে পারেন। অধ্যাপক হাসিনা খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত থেকে গবেষণা পরিচালনা করেন।
নয়.
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন বায়োটেকনোলজি বিভাগের সূচনা পর্বে এবং বিভাগের সিলেবাস প্রণয়নে তিনি ভূমিকা রাখেন।
দশ.
বাংলাদেশ সরকার অধ্যাপক হাসিনা খানের বায়োটেকনোলজি উন্নয়নে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা সব সময় কাজে লাগাতে আগ্রহী। ২০১৬ সাল থেকে তিনি ‘ন্যাশনাল টেকনিক্যাল কমিটির অন বায়োটেকনোলজির’ সদস্য হিসেবে কাজ করছেন।
এগার.
তিনি নয়াদিল্লির সাউথ এশিয়ান ইউনিভাসির্টির একাডেমিক কাউন্সিলের বহিস্থ সদস্য।
বার.
তিনি গবেষণায় ও শিক্ষায় চমৎকার অবদানের জন্য ২০০২ সালে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সের ফেলো নির্বাচিত হন।
তের.
তিনি দ্য ওর্য়াল্ড একাডেমি অব সায়েন্সের একজন সম্মানিত ফেলো।
চৌদ্দ.
তিনি বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সের প্রথম নারী সাধারণ সম্পাদক।
পনের.
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য হিসেবে ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ থেকে অধ্যাপক ড. হাসিনা খান চার বছরের জন্য সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন।
ষোল.
মেধাবী ছাত্রী ও অধ্যাপক ড. অধ্যাপক হাসিনা খানের ঝুলিতে রয়েছে দেশ-বিদেশের নাম করা সব পদক। বাংলাদেশ সরকার বিজ্ঞান গবেষণায় তার অবদানের জন্য দিয়েছেন ‘স্বাধীনতা পদক পুরস্কার’। যা তার কাজ ও পরিশ্রমকে সম্মানিত ও গৌরবান্বিত করেছে।
সতের.
জীবপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে ১৯৮৯ সালে ইউনেসকো/আরওএসটিএসসিএ কর্তৃক প্রদত্ত ইয়ং সায়েনটিস্ট অ্যাওয়ার্ড তিনি পান।
আঠার.
পাটের মলিকুলার বায়োলজি এবং জিনোমস সিকোয়েন্সের জন্য তিনি ২০১৫ সালে কাজী মাহবুল্লাহ স্বর্ণপদক ও ২০১৬ সালে ফরহাদ ট্রাস্ট পদকে ভূষিত হন।
দুর্দান্ত মেধাবী ও একজন সফল বিজ্ঞানী ড. হাসিনা খান- যা প্রথম দর্শনে দেখে বোঝা যায় না। তার মধ্যে নেই কোনো অহংকার, নেই দাম্ভিকতা। নিজেকে তিনি প্রচার সর্বস্ব করেননি। তিনি ছুটেছেন কেবল তার কাজ, তার গবেষণার পেছনে। ৯টা ৫টা শিক্ষকতার মধ্যে তিনি নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। অধ্যাপক ড. হাসিনা খানের কাছেই জানতে পারি বিজ্ঞান গবেষণা এমন যে, তার ফলাফল ৯টা ৫টায় পাওয়া যায় না। একজন সার্থক বিজ্ঞান গবেষককে অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত ফলাফলের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন কাজ করে যেতে হয়।
বিজ্ঞানে তাড়াহুড়ায় কোনো ভালো ফলাফল আসে না। একজন বিজ্ঞানীকে হতে হবে ধীরস্থির। অধ্যাপক ড. হাসিনা খান ধীরস্থিরতার জ্বলন্ত প্রমাণ। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বিজ্ঞানী হলেও তিনি তো নারী। ঘরের কাজের সাথে বিজ্ঞানের কাজ কীভাবে তিনি সমন্বয় করেছিলেন। তিনি হেসে বললেন, ‘ডক্টরেট করার সময় তেজস্ক্রিয় পদার্থের সংস্পর্শে থাকতে হতো। ঝুঁকি থাকায় দীর্ঘসময় সন্তান ধারণ করিনি। গবেষণাকাজে পিছিয়ে পড়তে চাইনি কখনো। তাই যাতে দীর্ঘ কর্মবিরতি না হয়, তাই দ্বিতীয়বার আর মাতৃত্বের স্বাদও নেওয়া হয়নি। তার একজন মাত্র কন্যা’ ।
ড. হাসিনা খান এখন ইউজিসির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আনন্দের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সে। তার চিন্তায় সারাক্ষণ বিজ্ঞান ।
হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলাম- বাসায় তার কাজে সহায়তা করার জন্য দক্ষ সহায়তাকর্মী আছে নিশ্চয়? তিনিও মৃদু হেসে বললেন- তিনি নিজের হাতেই এখনো প্রতিদিন রান্না করেন।
অধ্যাপক ড. হাসিনা খানের মতো নারী একদিনে তৈরি হয় না। তাদের কাজে থাকে পরিপূর্ণ সদিচ্ছা ও ধৈর্য। ফলে সাফল্য তাদের পায়ের কাছে চুপি চুপি আসে।
নারী দিবসে বাংলাদেশের স্বনামধন্য বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. হাসিনা খানকে নিয়ে লেখার কারণ হলো-নতুন প্রজন্মের নারীরা যেন বিজ্ঞান শিক্ষার দিকে আকৃষ্ট হন। তারা যেন সফল গবেষক হন। ড. হাসিনা খানের মতে, এখন বাংলাদেশে রয়েছে গবেষণার প্রচুর সুযোগ । গবেষকদের উচিত তাদের কাজের ক্ষেত্র তৈরি করে গবেষণায় পরিপূর্ণ মনোনিবেশ করা ।অধ্যাপক হাসিনা খানকে রোল মডেল করে নতুন প্রজন্মের নারীরা যদি এগিয়ে যান তবে এদেশ এগিয়ে যাবে ও তারাও গবেষক হিসেবে নিজেদের উজ্জ্বল করে তুলবেন।
লেখক: বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, লেখক, গবেষক।