এবার ডিবি বললো, ইনসুলিন না দিয়ে ‘মৃত্যু ঘটানো হয়’ সিআইপি হাসানের

0
15

প্রতিদিনের ডেস্ক
পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ মারা যান ২০২২ সালের ২৪ জানুয়ারি। মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করে ডিবি বলছে, জীবদ্দশায় হাসান আহমেদের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস ও অন্য আসামিরা তার চিকিৎসা না করে, নিয়মিত ইনসুলিন না দিয়ে অবহেলার মাধ্যমে ‘মৃত্যু ঘটানোর কাজটি’ নিশ্চিত করেন। এমন অভিযোগে হাসানের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসসহ আটজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছেন ডিবির পরিদর্শক আব্দুল হক।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন- স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসের বোন রুনা লায়লা ও তার স্বামী এরশাদ, স্ত্রীর বোন চাঁদনী নূর ও তার স্বামী মো. মেহমুদ রেজা, স্ত্রীর ভাই মোহাম্মদ সাহিম ফারুক ও মো. শাহরুখ খান সাজিদ এবং নিহতের শাশুড়ি পারভীন অকিল।
হাসান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় তার ছোট ভাই কবির আহমেদ ২০২২ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকার আদালতে একটি সিআর মামলা করেন। আদালত সিআর মামলাটি পল্টন থানাকে এজাহার হিসেবে নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। এরপর পল্টন থানার পুলিশ পরিদর্শক সেন্টু মিয়া ২০২৩ সালের ৩০ এপ্রিল আসামিদের বিরুদ্ধে ঘটনার সত্যতা না পেয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। তবে সেই চার্জশিটে মামলার বাদী নারাজি দিলে মামলা যায় ডিবির কাছে। একই বছরের ২ ডিসেম্বর ডিবির পরিদর্শক আব্দুল হক হাসান আহমেদের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসসহ আটজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন।
মামলায় আট আসামির মধ্যে জান্নাতুল ফেরদৌস, রুনা লায়লা, ফাহিম ফারুক, চাঁদনী ও রেজা আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে তারা আদালত থেকে জামিন পান। এছাড়া আসামি শাহরুখ খান, আহম্মেদ এরশাদ ও পারভীন পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
এ নিয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক আব্দুল হক বলেন, পপুলার লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান হাসান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলায় তার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসসহ আটজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছি। হাসানের স্ত্রী ও অপরাপর আসামিরা তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে নিয়মিত ইনসুলিন না দিয়ে অবহেলার মাধ্যমে মৃত্যু ঘটানোর কাজটি নিশ্চিত করেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
মামলার চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন, মামলার বাদীর ভাই হাসান আহমেদ পপুলার লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান। বাদী তার বড় ভাইয়ের পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ ধানমন্ডির বাসায় বসবাস করতেন। তবে বিয়ের পর থেকে স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস এবং তার বোন রুনা লায়লা ও পরিবারের সবাই মিলে বাদীর বড় ভাই হাসান আহমেদকে তার মা ও অন্য ভাইবোনদের সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ করতে দেননি। ভুক্তভোগীর কয়েকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা গচ্ছিত ছিল, যা তার স্ত্রী হাসান আহমেদের জীবদ্দশায় অসুস্থতার অজুহাতে নিজ নামে নিয়ে গিয়েছেন বলে তদন্তকালে প্রকাশ পায়। এছাড়া পপুলার লাইফের পক্ষ থেকে হাসান আহমেদকে সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করার জন্য সফিকুল ইসলামকে (মামলার সাক্ষী) বাসায় পাঠানো হলেও ১৫-২০ দিনের মধ্যেই ভুক্তভোগীর স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে বাসা থেকে তাড়িয়ে দেন।
এছাড়া ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর স্কয়ার হাসপাতাল থেকে অসুস্থ হাসান আহমেদকে বাসায় নিয়ে আসেন। সাক্ষীদের জবানবন্দির ভিত্তিতে ও গোপনীয় তদন্তে জানা যায়, আসামি জান্নাতুল ফেরদৌস ও অপরাপর আসামিরা হাসান আহমেদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে নিয়মিত ইনসুলিন না দিয়ে অবহেলার মাধ্যমে হাসান আহমেদের মৃত্যু ঘটানোর কাজটি নিশ্চিত করেন। ফলে ২০২২ সালের ২৪ জানুয়ারি ভুক্তভোগী হাসান আহমেদ মৃত্যুবরণ করেন।
মামলার চার্জশিটে আরও বলা হয়, আসামিরা একই সাধারণ উদ্দেশ্যে ও পরস্পর যোগসাজশে পরিকল্পিতভাবে মৃত্যু ঘটানোর অভিপ্রায়ে সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করাসহ অবেহেলা ও তাচ্ছিল্যপূর্ণভাবে চিকিৎসা করার মাধ্যমে মৃত্যু নিশ্চিত করে মর্মে তদন্তে প্রকাশ পায়।
চার্জশিটে বলা হয়েছে, এরূপ কার্যক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে সিআইপি হাসান আহমেদ ২০২২ সালের ২৪ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টার দিকে রূপায়ন তাজ টাওয়ারের ফ্ল্যাটে মারা যান। তার মৃত্যুজনিত ঘটনা ভিন্নখাতে প্রভাবিত করার জন্য আসামিরা কাকরাইলের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বারডেম হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আসামিদের বিরুদ্ধে ৩০৪/৩০৪-ক/২০১/৩৪ ধারায় অপরাধ প্রাথমিকভাবে সত্য বলে প্রমাণিত হয়। তবে তদন্তে পেনাল কোডের ৩০২ ধারার অপরাধ প্রমাণ হয়নি।
হাসানের সম্পত্তি লিখে দেওয়ার জন্য ক্রমাগত চাপ
হাসান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা করেন তার ছোট ভাই কবির আহমেদ (৫৪)। মামলায় দণ্ডবিধির ২০১/৩০২/৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগে বাদী উল্লেখ করেন, তার বড় ভাই হাসান আহমেদের সঙ্গে এক বিহারী নারী জান্নাতুল ফেরদৌসের বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই জান্নাতুল ফেরদৌস এবং তার বোন লায়লাসহ পরিবারের সদস্যরা মিলে তার বড় ভাই হাসান আহমেদকে বাদীসহ তার মা ও অন্য ভাইবোনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেননি। বাদীর পরিবারের কোনো সদস্য বাদীর ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে আসামিরা হাসান আহমেদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাতেন। সম্পত্তি আসামি জান্নাতুল ফেরদৌসের নামে লিখে দেওয়ার জন্য ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করা হতো বলে সুস্থ থাকা অবস্থায় তার বড় ভাই তাদের অবগত করেছিলেন।
হাসানের স্থাবর সম্পত্তি লিখে দেওয়ার জন্য নির্যাতন
মামলার অভিযোগে আরও বলা হয়, ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টা ৫ মিনিটের দিকে ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন হাসান আহমেদ। কিন্তু চিকিৎসা শেষ না করে আসামিরা ১১ অক্টোবর তারিখে পল্টনের বাসায় নিয়ে বন্দি করে রাখেন। বাদীসহ তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করে দেন। তার ব্যাংকে গচ্ছিত নগদ টাকা এবং কোম্পানির শেয়ার আত্মসাৎ করে এবং তার স্থাবর সম্পত্তি তার নামে লিখে দেওয়ার জন্য তাকে বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো শুরু করেন। বাদীর মা মনজুরা আহমেদ বাদীর ভাই হাসান আহমেদের শারীরিক সুচিকিৎসার জন্য পল্টন থানায় সে বছরের ৩ নভেম্বর একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।