তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে

0
16

প্রভাষ আমিন
বাংলাদেশে নির্বাচনে জেতার অনেকগুলো কৌশল আছে। সামরিক শাসনের আমলে নির্বাচন হতো নামকাওয়াস্তে। ফলাফল আগেই ঠিক করা থাকতো। এরপর এলো হোন্ডা, গুন্ডা আর ডান্ডার আমল। জোর যার মুল্লুক তার। যার গায়ে বা ট্যাকে জোর বেশি, সেই নির্বাচিত হতেন। যুগে যুগে নির্বাচনে জেতার কৌশল বদলেছে। এখন যেমন একতরফা নির্বাচনে কখনো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, কখনো প্রশাসনিক দখলে, কখনো ডামি প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে জেতা যায়।
নির্বাচনে ভোটারদের ভূমিকা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। ভোটাররাও কেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও ভোটকেন্দ্রে যান না। তবে প্রশাসনকে ঘুস দিয়ে নির্বাচনে জেতার চেষ্টাকে নজিরবিহীনই বলতে হবে। এমনিতে ক্ষমতাসীন দল পুলিশ ও প্রশাসনের আনুকূল্য পান, এটা সবাই জানেন। এ কারণেই বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে।
গত কয়েকটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া বা আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতাকেই জয়ের পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হতো। মনোনয়ন পেলে প্রার্থীরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতো। সবার ধারণা ছিল, দলকে জেতানোর দায়িত্ব শেখ হাসিনার। তবে এবার সেই ধারণায় ধাক্কা লেগেছে। ‘মনোনয়ন পেলেই জয়’ এ ধারণা গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ভেঙে গেছে।
বিএনপি না আসায় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখাতে আওয়ামী লীগ এবার নির্বাচনের মাঠ বিদ্রোহীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। তাতে ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতে চমক সৃষ্টি করেছেন। আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা মন্ত্রী, এমপি, কেন্দ্রীয় নেতার ভরাডুবি ঘটেছে এবার। জাতীয় পার্টি ২৬ আসনে আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা করলেও জয় পেয়েছে মাত্র ১১টি আসনে। সমঝোতার ২৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী না থাকলেও বিদ্রোহী প্রার্থীরা ছিলেন এবং জাতীয় পার্টির ১৫টি আসন কেড়ে নিয়েছেন।
২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরকারি দলের প্রার্থীদের জিতে যাওয়া নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। আইনে বৈধতা নিয়ে কোনো সমস্যা না থাকলেও নির্বাচনের আগেই সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যাওয়ার ঘটনা সরকারের নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছিল।
২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ নিয়ে মাত্র ৭টি আসন পেয়েছিল। সেটা নিয়েও সমালোচনা কম হয়নি। আগের দুটি নির্বাচনে সমালোচনার পয়েন্টগুলো মাথায় রেখে সরকারি দল এবার ভিন্ন কৌশল নিয়েছিল। মাঠ উন্মুক্ত থাকার সুবাদে ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতে আসেন।
তাতে অবশ্য সরকারি দলের কোনো ক্ষতি হয়নি। জিতে আসা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা। জেতার পর তারা সরকারি দলের সাথেই আছেন। তাই এবারের সমালোচকদের মুখও বন্ধ করা গেছে, আবার সংসদে ভিন্নমতের কণ্ঠও রুদ্ধ করা গেছে।
হোন্ডা, গুন্ডা, ডান্ডা, মিডিয়া ক্যু, প্রশাসনিক ক্যু, একতরফা, রাতের ভোট ইত্যাদি নানা কৌশল ডিঙিয়ে বাংলাদেশ ঘুস দিয়ে নির্বাচনে জেতার চেষ্টার যুগে প্রবেশ করলো। ভাগ্যিস জেতেননি, জিতলে এই যুগে প্রবেশের খবর হয়তো আড়ালেই থেকে যেতো। বাংলাদেশে ঘুস ছাড়া কোনো কাজ হয় না। পাসপোর্ট, এনআইডি, বিআরটিও, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, চাকরি, পোস্টিং- ঘুস ছাড়া বাংলাদেশে কোনো সেবা মেলে না। তাই বলে ঘুস দিয়ে এমপি বনে যাওয়া!
সাতক্ষীরা-৪ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য এইচ এম গোলাম রেজা। জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ গোলাম রেজা ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের একান্ত সচিব। দলের মনোনয়ন না পেলেও এবার তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। গত সপ্তাহে দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানা যায়, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে জয় নিশ্চিত করতে তিনি সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরকে দেড় কোটি টাকা দিয়েছিলেন।
গোলাম রেজার ছেলে এবং ছেলের শ্বশুর জেলা প্রশাসকের বাসায় নগদ দেড় কোটি টাকা পৌঁছে দিয়েছিলেন। বিনিময়ে জেলা প্রশাসক তাকে নির্বাচনে প্রশাসনিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনে তিনি প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা তো পানইনি। বরং উল্টো তাকে পদে পদে অসহযোগিতা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন এইচ এম গোলাম রেজা। আর অভিযোগ নিছক বায়বীয় নয়।
এইচ এম গোলাম রেজা সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দুই পৃষ্ঠার অভিযোগ জমা দিয়েছেন। অবশ্য সাথে সাথেই তিনি অভিযোগ করেননি। নির্বাচনে ভরাডুবির পর গত ৫ ফেব্রুয়ারি এইচ এম গোলাম রেজা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে ডিসির কাছে ঘুসের টাকা ফেরত চান। কিন্তু টাকা ফেরত না দিয়ে উল্টো ছয়দিন পর এইচএম গোলাম রেজাসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের নির্বাচনী কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার মামলা দেওয়া হয়।
এজাহারে বলা হয়, আগুনের ঘটনা ঘটেছে নির্বাচনের আগের দিন ৬ জানুয়ারি। অথচ মামলাটি করা হয় ঘটনার ৩৬ দিন পর। বোঝাই যাচ্ছে, ঘুসের টাকা ফেরত না দিতে হয়রানি করতেই এই মামলা করা হয়েছে। সাবেক হুইপ গোলাম রেজা বাধ্য হয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিয়েছেন।
অভিযোগের ব্যাপারে গোলাম রেজা সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্বাচনে প্রচারণা শুরুর পর থেকেই ডিসি আমাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে হয়রানি শুরু করেন। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির আশ্বাস দিয়ে ছেলে ও তার শ্বশুরের কাছ থেকে দেড় কোটি টাকা নিয়ে ডিসি প্রতারণা করেন। এটি লজ্জাজনক।’
আমাদের রাজনীতি, প্রশাসন কলুষিত হয়েছে অনেক আগেই। গোলাম রেজার অভিযোগ তারই একটি চিত্র মাত্র। ডিসি কথা রাখেননি বলে এখন জানাজানি হচ্ছে। জানাজানি যেহেতু হয়েছেই, এখন এই অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত দরকার। রাজনীতি থেকে, প্রশাসন থেকে এই দুষ্টক্ষতগুলো উৎপাটন করতে না পারলে দেশ কখনো ঠিক হবে না।
গোলাম রেজার ছেলের শ্বশুর ব্যবসায়ী মো. ইউনুছ আলী জানিয়েছেন, ‘নির্বাচনের তিনদিন আগে ব্যাগভর্তি করে রাত ৯টার দিকে এই টাকা ডিসির বাসভবনে দিয়ে আসি। টাকার ব্যাগ পেয়ে ডিসি বললেন, কত আছে এখানে? তখন মুখে না বলে লিখে দেখাই, দেড় কোটি। পরে টাকাসহ ব্যাগটি ডিসি নিজেই আমাদের সামনেই ড্রয়িংরুমের দেওয়ালঘেঁষা একটি বাক্সে রাখেন।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের পর টাকা ফেরত চেয়েছিলাম। ডিসি বললেন, টাকা তো হাতে নেই। খরচ হয়ে গেছে। এরপরই কালীগঞ্জ থানায় মামলার খড়্গ আসে। পুরো বিষয়টি ছিল পূর্বপরিকল্পিত। একদিকে টাকা নিয়েছেন, অন্যদিকে মিথ্যা মামলার ছক তৈরি করে রেখেছিলেন। টাকা ফেরত চাইলেই যেন মামলার ভয় দেখিয়ে এলাকাছাড়া করা যায়।’
সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির যথারীতি অভিযোগ অস্বীকার করেন। তবে তিনি অস্বীকার করলেই অভিযোগ মিথ্যা হয়ে যাবে না। আবার গোলাম রেজা অভিযোগ করলেই সেটা সত্যি হয়ে যাবে না। পুরো ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তবে একটা কথা, গোলাম রেজা যদি জেলা প্রশাসকের সহায়তায় জিতে যেতেন, তাহলে নিশ্চয়ই অভিযোগও করতেন না, টাকাও ফেরত চাইতেন না।
প্রথমত আমি ধরে নিচ্ছি, অভিযোগটি মিথ্যা। হয়তো গোলাম রেজা মামলা থেকে বাঁচতে জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। তদন্তে যদি প্রমাণিত হয়, অভিযোগটি মিথ্যা। তাহলে মিথ্যা অভিযোগ এনে প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার দায়ে গোলাম রেজার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে আমার ধারণা অভিযোগটি সত্যি। তদন্ত করে অভিযোগটি সত্যি হলে অভিযুক্ত এবং অভিযোগকারী দুজনের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে হবে। যিনি ঘুস নিয়েছেন, তিনি তো অবশ্যই দোষী। ঘুস দেওয়াও কিন্তু অপরাধ।
অভিযোগটি সত্যি হোক আর মিথ্যা, এইচ এম গোলাম রেজার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে। ঘুস দেওয়া তো অবশ্যই অপরাধ, তারচেয়ে বড় কথা হলো, ঘুস দেওয়ার জন্য দেড় কোটি টাকা তিনি কোথায় পেলেন। এই অর্থের উৎস জানতে চাইতে পারে দুর্নীতি দমন কমিশন। গোলাম রেজার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে নির্বাচন কমিশনও। কারণ নির্বাচনে একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা খরচ করতে পারেন। সেখানে গোলাম রেজা লিখিতভাবে স্বীকার করেছেন, তিনি নির্বাচনে জিততে দেড় কোটি টাকা ঘুসই দিয়েছেন। নির্বাচনে নিশ্চয়ই আরও ব্যয় হয়েছে।
আমাদের রাজনীতি, প্রশাসন কলুষিত হয়েছে অনেক আগেই। গোলাম রেজার অভিযোগ তারই একটি চিত্র মাত্র। ডিসি কথা রাখেননি বলে এখন জানাজানি হচ্ছে। জানাজানি যেহেতু হয়েছেই, এখন এই অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত দরকার। রাজনীতি থেকে, প্রশাসন থেকে এই দুষ্টক্ষতগুলোকে উৎপাটন করতে না পারলে দেশ কখনো ঠিক হবে না।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।