ঝুঁকিতে রোগীরা হাসপাতালে ব্যবস্থাপত্রের বদলে ‘চিরকুট’ দেন চিকিৎসকরা

0
11

প্রতিদিনের ডেস্ক
চিকিৎসকদের অবহেলা ও গাফিলতির কারণে নজিরবিহীন অনিয়ম চলছে সিলেটের বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। শহরমুখী প্রবণতা, অফিস চলাকালে ‘প্রাইভেট প্র্যাকটিস’ ও জনবল সংকটের কারণে খুঁড়িয়ে চলছে স্বাস্থ্যসেবা। শুধু তাই নয়, ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) লেখার প্রতি অনীহা থাকায় ‘চিরকুটে’ ওষুধ লিখে রোগীদের বিপদে ফেলছেন চিকিৎসকরা।
এতে করে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তৃণমূলের চিকিৎসাসেবা গ্রহীতাদের। বিশেষ করে ব্যবস্থাপত্র না থাকায় ভুল নিয়মে ওষুধ খেয়ে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে অনেক রোগীকে। সিলেটের কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে এসব চিত্র উঠে এসেছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, ব্যবস্থাপত্রের প্রতি রোগীদের অনাগ্রহ ও কাগজের বরাদ্দ কম থাকায় ‘চিরকুটে’ ওষুধ লেখেন চিকিৎসকরা। তাছাড়া জনবল সংকটের কারণে চিকিৎসাসেবাও কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে।
এদিকে এ দুই উপজেলা ছাড়া জেলার অন্যান্য হাসপাতালে ‘চিরকুটে’ ওষুধ না লেখার চর্চা না থাকলেও জনবল সংকটের কারণে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা। বাধ্য হয়ে সিলেট শহরে আসতে হচ্ছে রোগীদের। এতে করে জেলা শহরের সরকারি বেসরকারি হাসপাতাগুলোতে চাপ বাড়ছে রোগীদের। আর অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বেডে ঠাঁই না পেয়ে এ হাসপাতালের মেঝেতে শুয়েও চিকিসা নিচ্ছেন অনেক রোগী।
সম্প্রতি সিলেটের কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে দেখা গেছে, কাউন্টার থেকে ৫ টাকা দামের টিকিটের বদলে সিলযুক্ত সাদা কাগজ (চিরকুট) রোগীকে দেওয়া হয়। চিকিৎসকরা আলাদা ব্যবস্থাপত্র না দিয়ে এই চিরকুটেই ওষুধ লিখে দিচ্ছেন। এই দুই ধাপ শেষে ডিসপেনসারিতে (ওষুধ বিতরণের রুম) গেলে ওষুধের নাম লেখা সম্বলিত চিরকুট রেখে দিয়ে ওষুধ দেন দায়িত্বশীলরা। এ সময় রোগীদের ওষুধ খাওয়ার নিয়ম মুখে বলে দেন সংশ্লিষ্টরা। এতে অনেকে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই ভুলে যান খাওয়ার নিয়ম।এক্ষেত্রে ফার্মেসি কিংবা বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের দ্বারস্থ হতে দেখা গেছে রোগীদের।
কানাইঘাট উপজেলার দুর্লভপুর গ্রামের ৬০ বছর বয়সী মন্তাজ আলী শ্বাসকষ্ট ও তীব্র পেটে ব্যথা নিয়ে উপজেলা হাসপাতালে আসেন। সকাল ১০টা থেকে অপেক্ষা করার পর ১১টার দিকে আসেন চিকিৎসক। এসময় কোনো কিছু না শুনেই চিরকুটে দুইটি ওষুধ লিখে দেন। পরে চিরকুটটি ডিসপেনসারিতে (ওষুধ বিতরণের রুম) নিয়ে গেলে সেটি রেখে দিয়ে মন্তাজ আলীর হাতে কিছু ওষুধ দেওয়া হয়। এসময় অনেক রোগীর ভিড়ে সেবনের নিয়ম মুখে বলে দিলেও সেটি পরক্ষণে ভুলে যান তিনি।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে মন্তাজ আলী বলেন, কয়েকটা ওষুধ হাতে দিয়ে কখন খেতে বলেছে সেটা ভুলে গেছি। এখন ফার্মেসির লোকদের বলে নিয়ম জেনে নেবো। এ হাসপাতালে সব সময় এভাবেই চিকিৎসা দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসে উপজেলার পাত্রমাটি এলাকার হাবিব আহমদ বলেন, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়াসহ বেশ কিছু সমস্যা নিয়ে এসেছি। কিন্তু ছোট্ট একটি কাগজে কয়েকটি ওষুধ লিখে দিয়ে আমাকে বিদায় দেওয়া হয়েছে। এ ওষুধ খেয়ে না কমলে অন্য কোনো চিকিৎসকের কাছে গিয়ে কী ওষুধ খেয়েছি সেটি বলারও সুযোগ নেই। আমাকে কোনো প্রেসক্রিপশন দেওয়া দেয়নি।
তিনি বলেন, সরকারি ফি দিয়ে টিকিট কিনেছি। কিন্তু কোনো প্রমাণপত্র নেই। এভাবে আমাদের অবহেলা করা হচ্ছে। এজন্যই বাধ্য হয়ে অমাদেরকে সিলেট শহরে যেতে হয়।একই অবস্থা সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও। ৭ বছরের শিশু সন্তানকে নিয়ে এ হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসেছেন ঈদগাহ বাজার এলাকার ফরিদা বেগম।
তিনি বলেন, ৫ টাকা মূল্যের টিকিট নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি সিলযুক্ত একটি চিরকুটে কিছু ওষুধ লিখে দেন। ডিসপেনসারিতে যাওয়ার পর সেই চিরকুটটি রেখে ওষুধ দিয়ে বিদায় দেওয়া হয়। এখন এ ওষুধে অসুখ না কমলে পরবর্তীতে চিকিৎসকে কি ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে বলতে পারবো না।
এ বিষয়ে কানাইঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সুবল চন্দ্র বর্মন বলেন, হাসপাতাল থেকে ওষুধ নেওয়ার পর রোগীরা ব্যবস্থাপত্র ছিঁড়ে ফেলে দেয়। যার কারণে চিকিৎসকরাও মনক্ষুণ্ন। রোগীদের এমন অনাগ্রহের কারণে চিকিৎসকরা ব্যবস্থাপত্র লেখেন না। তবে আগামীতে সকল রোগীদের ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।জকিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শেখ মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, রোগীকে ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হলে তারা সেটি ফেলে দেয়। প্রতিদিন ডিসপেনসারির সামনে ব্যবস্থাপত্র ছিঁড়ে ফেলা অবস্থায় পাওয়া যায়। যার কারণে ব্যবস্থাপত্র লিখতে চান না চিকিৎসকরা।
তিনি বলেন, জরুরি বিভাগে যারা চিকিৎসা নেন তাদেরকে ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়। বহির্বিভাগে যারা আসেন তাদেরকে চিরকুটে ওষুধ লিখে দেওয়া হয়। এসব রোগীদের ওষুধ খাওয়ার নিয়ম ফার্মাসিস্ট বলে দেন।
এ বিষয়ে সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় দত্ত বলেন, এ ধরনের চর্চা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের সকল উপজেলায় মূল ব্যবস্থাপত্রের সঙ্গে ছোট কাগজে ওষুধ লিখে দেওয়া হয়। সেটি দিয়ে সরকারি ওষুধ দেওয়া হয়। মূল ব্যবস্থাপত্রে খাবারের নিয়মসহ সবকিছু লেখা থাকে।
তিনি বলেন, ব্যবস্থাপত্রের বদলে চিরকুটে লেখা চর্চা হয়ে গেলেও চলবে না। কেউ না নিলে সেটা তার বিষয়। হাসপাতালের পক্ষ থেকে সবাইকে ব্যবস্থাপত্র দিতে হবে। কিন্তু কেন চিকিৎসকরা লেখেন না সেটা তদন্ত করে দেখা হবে।
এ প্রসঙ্গে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ডা. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, উপজেলা হাসপতালগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে এবং জেলার বিশেষায়িত হাসপাতালে রোগীর চাপ কমাতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী কাজ করছেন। তিনি এ বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যার কারণেই এ সমস্যা সমাধানে কাজ শুরু করেছেন।
তিনি আরও বলেন, সকল উপজেলা হাসপাতালের সেবা সমান নয়। অনেক হাসপাতালে অনেক ধরনের সংকট রয়েছে। সেসব সংকটের কারণে চাইলেও সকল সেবা দেওয়া সম্ভব না। তবে সরকারের পক্ষ থেকে উপজেলা হাসপাতালগুলোতে জনবল ও সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা হলে জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ কমবে বলে জানান তিনি।