দুদক যেন নেতিয়ে পড়া বাঘ

0
9

প্রতিদিনের ডেস্ক
চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের হলফনামায় অস্বাভাবিক সম্পদের তথ্য আলোড়ন সৃষ্টি করে সারাদেশে। অথচ তখনও নীরব ছিল দুদক। যদিও সংস্থাটির দাবি, এ বিষয়ে কাজ চলছে, আরও সময় লাগবে। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি অফিসে অনিয়ম, দুর্নীতি চলছে দেদারসে, প্রায় প্রতিদিনই যার খবর আসছে গণমাধ্যমে। অর্থপাচার প্রতিরোধে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো। এক্ষেত্রেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচকের (সিপিআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় দুই ধাপ অবনমন হয়েছে বাংলাদেশের। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ এখন দশম স্থানে। এর পরও অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধকারী সংস্থা দুদকের পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
দুদক আতঙ্কে এক সময় দিন কেটেছে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা ও নানান শ্রেণি-পেশার মানুষের। দুর্নীতি মামলায় জেল খেটেছেন অনেকেই, কেউ কৌশলে দেশ ছেড়েছেন। তবে এখন আর সেই সময় নেই, ভাটা পড়েছে দুদকের কাজে। ২০২৩ সালে দুদকে জমা পড়ে ১৫ হাজার ৪৩৭টি অভিযোগ। যাচাই-বাছাই শেষে ৮৪৫টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করেছে সংস্থাটি, যা মোট অভিযোগের মাত্র ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। অর্থাৎ অভিযোগের ৯৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।দুদক আতঙ্কে এক সময় দিন কেটেছে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা ও নানান শ্রেণি-পেশার মানুষের। দুর্নীতি মামলায় জেল খেটেছেন অনেকেই, কেউ কৌশলে দেশ ছেড়েছেন। তবে এখন আর সেই সময় নেই, ভাটা পড়েছে দুদকের কাজে।
২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে দুদকে জমা পড়া অভিযোগ ও অনুসন্ধানের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন অভিযোগ জমা পড়েছে গত বছর। এর মধ্যে করোনা অভিঘাতের পর সবচেয়ে কম অভিযোগ জমা পড়েছিল ২০২১ সালে। ওই বছর মাত্র ১৪ হাজার ৭৮৯টি অভিযোগ জমা পড়ে।
প্রতি বছরের কাজের মূল্যায়ন প্রকাশ করতে বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করে দুদক। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরের অনুসন্ধান তদন্তের ওপর ভিত্তি করে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে সংস্থাটি। তবে নতুন বছরের তিন মাস পার হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে তা এখনো প্রকাশ করা হয়নি।
২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে কম অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়েছিল ২০২০ সালে। ওই বছর ১৮ হাজার ৪৮৯ অভিযোগের বিপরীতে অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেওয়া হয় ৮২২টি। এরপর দ্বিতীয় সর্বনিম্ন অভিযোগ আমলে নেওয়া হয় ২০২৩ সালে।
নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণের দুদকের কাজে গতি হারিয়েছে। দুদক চেয়ারম্যান, কমিশনার ও শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের বড় অংশ সরকারের ঘনিষ্ঠভাজন হওয়ায় তারা সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারছে না। দুদক ব্যস্ত থাকছে চুনোপুঁটিদের নিয়ে।
দুদক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশিরভাগ অভিযোগ দুদকের তফসিলভুক্ত না হওয়ায় সংস্থাটির পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ অনুসন্ধানের সুযোগ নেই। এছাড়া অভিযোগের একটি বড় অংশ ভিত্তিহীন ও ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে আসায় তা আমলে নিতে পারছে না সংস্থাটি।দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বার্ষিক প্রতিবেদনের বিষয়ে বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামা নিয়ে তিনি বলেন, ‘হলফনামা নিয়ে কাজ করছে দুদক। এতে আরও সময় লাগতে পারে।’
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ দাবি করেন, দুদকের এখতিয়ারভুক্ত যে কোনো অপরাধ তদন্ত করে মামলার মাধ্যমে আসামিদের আদালতে সোপর্দ করা হয়। এমনকি সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়েও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের দাবি, ‘নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে দুদক কাজে গতি হারিয়েছে। দুদক চেয়ারম্যান, কমিশনার ও শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের বড় অংশ সরকারের ঘনিষ্ঠভাজন হওয়ায় তারা সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারছে না। দুদক ব্যস্ত থাকছে চুনোপুঁটিদের নিয়ে।’
দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের দুই ধাপ অবনমন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গত কয়েক বছর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ঘোষিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার সবচেয়ে আলোচিত সময় ছিল। তবে এ সময়ে এ ঘোষণাকে চর্চায় রূপ দেওয়ার সুনির্দিষ্ট কৌশল ও কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়নি। উপরন্তু এ সময়ে দুর্নীতির ব্যাপকতা ঘনীভূত ও বিস্তৃত হয়েছে। ঋণখেলাপি, জালিয়াতি ও অর্থপাচারে জর্জরিত ব্যাংক খাতের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বরং এজন্য যারা দায়ী, তাদের জন্য বিচারহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। দুদক ও অন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমনে কার্যকর দৃষ্টান্ত দেখাতে পারেনি, দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারেনি। দুদকসহ বিভিন্ন জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব ব্যাপকতর হয়েছে।’
প্রতিবেদনে মামলা ও অন্য তথ্য
প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালে বিভিন্ন অভিযোগে ৪০৪টি মামলা করেছে দুদক। এছাড়া ২০২২ সালে ৪০৬টি, ২০২১ সালে ৩৪৭টি, ২০২০ সালে ৩৪৮টি ও ২০১৯ সালে ৩৬৩টি। ২০২৩ সালে ৩৬৩টি মামলার চার্জশিট অনুমোদন করে সংস্থাটি। এছাড়া ২০২২ সালে ২২৪টি, ২০২১ সালে ২৬০টি, ২০২০ সালে ২২৮টি ও ২০১৯ সালে ২৬৭টি মামলার চার্জশিট অনুমোদন করা হয়।
গত বছর সংস্থাটিতে অভিযোগ জমা পড়ে ১৫ হাজার ৪৩৭টি। এসব অভিযোগ থেকে অনুসন্ধানের জন্য নেওয়া হয়েছে ৮৪৫টি, যা মোট অভিযোগের মাত্র ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ২০২২ সালে মোট অভিযোগ পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি, অনুসন্ধানের জন্য নেওয়া হয় ৯০১টি, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ২০২১ সালে অভিযোগ জমা পড়ে ১৪ হাজার ৭৮৯টি, অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয় ৫৩৩টি, যা মোট অভিযোগের ৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। ২০২০ সালে ১৮ হাজার ৪৮৯টি অভিযোগ জমা পড়ে, অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয় ৮২২টি। মোট অভিযোগের যা ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ। এছাড়া ২০১৯ সালে ২১ হাজার ৩৭১টি অভিযোগ জমা পড়ে, অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয় এক হাজার ৭১০টি, যা মোট অভিযোগের ৮ শতাংশ।
দুদকের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রপতি কিছুটা নাখোশ থাকতে পারেন, হয়তো সে কারণেই তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাননি। ফলে রেওয়াজ রক্ষা না করে দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হয়নি।
শুধু মামলা নয়, বিভিন্ন মামলায় আসামিদের জরিমানা করে দুদক। এর মধ্যে ২০২৩ সালে বিভিন্ন মামলায় আসামিদের এক হাজার ৬৮৩ কোটি ৬৭ লাখ ৩৭ হাজার ৫৪৬ টাকা জরিমানা করেছে সংস্থাটি, যা ২০২২ সালের তুলনায় প্রায় এক হাজার কোটি টাকা কম। ২০২২ সালে বিভিন্ন মামলায় আসামিদের জরিমানা করা হয়েছিল ২ হাজার ৬৩২ কোটি ৪১ লাখ ৪৩ হাজার ৭৮৩ টাকা। পাশাপাশি গত এক বছরে রাষ্ট্রের অনুকূলে আদালতের নির্দেশে ১৭ কোটি ৯৭ লাখ ৬৩ হাজার ৭৫ টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে দুদক।
রাষ্ট্রপতির সাক্ষাতের অনুমতি পায়নি কমিশন
দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর তা রাষ্ট্রপতির কাছে আনুষ্ঠানিকতভাবে জমা দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সংস্থাটি। তবে চলতি বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন জমা ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে চাইলে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের সাক্ষাতের অনুমতি দেননি। তাই রেওয়াজ ভেঙে দুদকের মহাপরিচালক (প্রশাসন) মো. শাহরিয়াজ বঙ্গভবনে বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দেন।
এ বিষয়ে অনেকের ধারণা, সংস্থাটির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রপতি কিছুটা নাখোশ থাকতে পারেন, হয়তো সে কারণেই তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাননি। ফলে রেওয়াজ রক্ষা না করে দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হয়নি।
সাংবাদিক প্রবেশে আসছে কড়াকড়ি
২৮ মার্চের পর দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলামকে দুদক ভবনের বাইরে অবস্থিত মিডিয়া সেন্টারে অফিস করতে বলা হয়েছে। বর্তমানে সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে জনসংযোগ কর্মকর্তার কাছে যান গণমাধ্যমকর্মীরা।
জানা গেছে, জনসংযোগ কর্মকর্তাকে মূল ভবনের বাইরে রাখার মাধ্যমে দুদকে গণমাধ্যমকর্মী প্রবেশে কড়াকাড়ি আরোপ হতে পারে। এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে দুদক সচিবকে আহ্বান জানিয়েছেন সাংবাদিকরা। জবাবে সচিব জানান, এটি কমিশনের সিদ্ধান্ত। তবে উদ্বেগের বিষয়টি তিনি কমিশনকে অবহিত করবেন বলে জানান।