‘আমরা নিজের দেশেই অদৃশ্য’: মোদির ভারতে মুসলিমদের অভিজ্ঞতা

0
10

প্রতিদিনের ডেস্ক
ছয় বছর আগে, উত্তর ভারতের আগ্রা শহরের একটি সুপরিচিত স্কুল থেকে একটি মুসলমান বালক অপমান ও ক্ষোভে রক্তবর্ণ হয়ে বাড়ি ফিরেছিল। ৯ বছর বয়সী ছেলেটি তার মাকে জানায়, ‘আমার সহপাঠীরা আমাকে পাকিস্তানি সন্ত্রাসী বলে ডাকে।’
তার মা রীমা আহমেদ কজন লেখক এবং কাউন্সিলর। তিনি বলেন, দিনটির কথা তার এখনও তার স্পষ্ট মনে আছে। তিনি বলেন, ‘ক্রদ্ধ ছোট ছেলেটি তার হাতের মুঠি এতটাই শক্ত করে চেপে ধরেছিল যে, তার তালুতে নখের দাগ বসে যায়। সে খুব রেগে গিয়েছিল।’
তার ছেলে স্কুলের ওই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, যখন শিক্ষক ক্লাস থেকে চলে যান, তখন তার সহপাঠীরা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে শুরু করে। সেই সময় একদল ছেলে তার দিকে ইশারা করে বলে, ‘ও একটা পাকিস্তানি সন্ত্রাসী। ওকে মেরে ফেল!’
ছেলেটি জানায়, তার কিছু সহপাঠী তাকে নর্দমার কীট বলেও কটাক্ষ করতো। রীমা আহমেদ যখন এ নিয়ে অভিযোগ করেন, তখন তাকে বলা হয়েছিল- তারা ‘মনগড়া কথা বলছেন… এমন কিছুই ঘটেনি’।
রীমা হমেদ তার ছেলেকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনেন। ১৬ বছর বয়সী ছেলেটি বাড়িতে এখন বসে পড়াশোনা করছে। তিনি বলেন, ‘আমি আমার ছেলের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা টের পেয়েছি, যে অনুভূতি আমার বেড়ে ওঠায় কখনও পেয়েছি বলে মনে করতে পারি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘হয়তো শ্রেণি সুবিধা আমাদের সবসময় মুসলিম ভাবার থেকে রক্ষা করেছিল। এখন মনে হচ্ছে শ্রেণি এবং সুবিধার কারণে আপনি আরও স্পষ্ট লক্ষ্যে পরিণত হচ্ছেন।’
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর থেকে, ভারতের ২০ কোটি মুসলমানদের জীবনযাপন অশান্ত হয়ে পড়েছে। সন্দেহভাজন গরু ব্যবসায়ীদের গণধোলাই দিয়ে মেরেছে কিছু উগ্র হিন্দু গোষ্ঠী এবং মুসলমান মালিকানাধীন ছোট ব্যবসাকে লক্ষ্যবস্তু করেছে তারা।
মসজিদের বিরুদ্ধে পিটিশন ফাইল করা হয়েছে। মুসলিম নারীদের অনলাইন ‘নিলাম’ করা নিয়ে ইন্টারনেটে ট্রল করা হয়েছে। ডানপন্থি গোষ্ঠী এবং মূলধারার কিছু গণমাধ্যম ‘জিহাদ’ – ‘লাভ জিহাদ’ এর অভিযোগ দিয়ে ইসলামোফোবিয়াকে উস্কে দিয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, মুসলিম পুরুষদেরকে বিয়ের মাধ্যমে হিন্দু নারীদের ধর্মান্তরিত করার মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়েছে। এবং মুসলিম বিরোধী বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বেড়েছে- তার তিন চতুর্থাংশ বিজেপি শাসিত অঞ্চলগুলোতে ঘটেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
‘ভারতের মুসলমান জনগোষ্ঠী যেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে পড়েছেন, তারা নিজের দেশেই অদৃশ্য সংখ্যালঘু,’ এ কথা বলেছেন জিয়া উস সালাম, যিনি ‘বিয়িং মুসলিম ইন হিন্দু ইন্ডিয়া’ বইয়ের লেখক।
কিন্তু বিজেপি এবং মোদি ভারতে সংখ্যালঘুদের সাথে দুর্ব্যবহারের বিষয়টি অস্বীকার করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিউজউইক ম্যাগাজিনকে বলেছেন, ‘এগুলি কিছু লোকের বক্রোক্তি যারা তাদের বিভ্রমে বাইরে গিয়ে মানুষের সাথে মেশার প্রয়োজন বোধ করে না। এমনকি ভারতের সংখ্যালঘুদের কাছেও ‌এসব ব্যাখ্যা অচল।’রীমা আহমেদের পরিবার কয়েক দশক ধরে আগ্রায় বসবাস করছে। তিনি ওই শহরের অলিগলি এবং জনাকীর্ণ বাড়ির মধ্যে থাকা অনেক হিন্দু বন্ধুদের মধ্যে- পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন। ২০১৯ সালে রীমা আহমেদ একটি স্কুল হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে বের হয়ে যান, যেখানে মাত্র দুজন মুসলমানদের মধ্যে একজন ছিলেন তিনি।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ভারত বিমান হামলা শুরু করার পর ওই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে একটি ম্যাসেজ পোস্ট করা হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এই সিদ্ধান্ত নেন। গ্রুপের ওই ম্যাসেজে লেখা ছিল, ‘যদি তারা আমাদের ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আঘাত করে, আমরা তাদের বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে হত্যা করব’।
সন্ত্রাসী ও ভারতের শত্রুদের তাদের বাড়ির ভেতরে হত্যা করার বিষয়ে মোদি যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তার সাথে গ্রুপের ওই বার্তার মিল পাওয়া যায়। মিসেস আহমেদ স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমি আর শান্ত থাকতে পারিনি। আমি আমার বন্ধুদের বলেছি তোমাদের সমস্যা কী? তোমরা কি বেসামরিক মানুষ ও শিশুদের হত্যাকে প্রশ্রয় দাও?’
তিনি শান্তির পক্ষে প্রচারণায় বিশ্বাসী ছিলেন। প্রতিক্রিয়াও আসে সাথে সাথেই। তিনি বলেন, ‘একজন জিজ্ঞেস করে, তুমি কি শুধু মুসলিম বলেই পাকিস্তানপন্থি? তারা আমাকে দেশবিরোধী বলেও অভিযুক্ত করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অহিংসার পক্ষে কথা বলাকে দেশবিরোধিতা বলে গণ্য করা হয়। আমি তাদের বলেছিলাম- দেশকে সমর্থন করার জন্য আমাকে সহিংস হতে হবে না। আমি এই গ্রুপ থেকে বের হয়ে যাচ্ছি।’
পরিবেশে যে বদলে গিয়েছে সেটা অন্যভাবেও অনুভব করতে পেরেছেন মিসেস আহমেদ। দীর্ঘদিন ধরে, তার বিশাল বাড়িটি লিঙ্গ বা ধর্ম নির্বিশেষে তার ছেলের সহপাঠীদের জন্য একটি আড্ডার জায়গা হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এখন ‘লাভ জিহাদ’ এর উৎপাতে হিন্দু মেয়েদের একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চলে যেতে বলেন তিনি, যেন তারা ছেলের ঘরে বেশি সময় না কাটায়।
তিনি বলেন, ‘আমি আর আমার বাবা, আমার ছেলেকে বসিয়ে বলেছিলাম- পরিবেশ ভালো নয়- তোমার বন্ধুত্ব সীমিত করতে হবে, সাবধানে থাকতে থাকবে, বেশি সময় বাইরে থাকা যাবে না। বলা যায় না, বিষয়গুলো যেকোনেও সময় ‘লাভ জিহাদে’ পরিণত হতে পারে।’
আগ্রার পঞ্চম প্রজন্মের বাসিন্দা পরিবেশবাদী কর্মী ইরামও স্থানীয় স্কুলে কাজ করার সময় শহরের শিশুদের মধ্যে কথোপকথনে পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন। ‘আমার সাথে কথা বলবেন না, আমার মা বারণ করেছে,’ তিনি এই কথাটি একটি শিশুকে তার একজন মুসলিম সহপাঠীর উদ্দেশে বলতে শুনেছেন।
‘আমি ভাবলাম, সত্যিই?! এটি তাদের গভীরে জমে থাকা (মুসলিমদের নিয়ে) ফোবিয়ার প্রতিফলন। এটি বাড়তে বাড়তে এমন রূপ নেবে যা আমরা সহজে নিরাময় করতে পারব না,’ ইরাম বলেন।তার নিজেরও অনেক হিন্দু বন্ধু ছিল, এবং একজন মুসলিম নারী হিসেবে তিনি কখনও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেননি।
অবশ্য শুধু বাচ্চাদের মধ্যেই এই বিষয়গুলো সীমাবদ্ধ নেই। আগ্রার একটি ব্যস্ত রাস্তার পাশে নিজের ছোট অফিসে বসে স্থানীয় সাংবাদিক এবং আন্তঃধর্ম সংগঠক সিরাজ কোরেশি হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে পুরোনো বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করে বিলাপ করেন।
তিনি সাম্প্রতিক এক ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, শহরে ছাগলের মাংস সরবরাহকারী এক ব্যক্তির পথ আটকে হিন্দু ডানপন্থি গোষ্ঠীর সদস্যরা তাকে পুলিশে সোপর্দ করেছিল এবং জেলে নিক্ষেপ করেছিল। কুরেশি বলেন, ‘তার যথাযথ লাইসেন্স ছিল, কিন্তু পুলিশ তারপরও তাকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।’
মুসলমান যাত্রীদের কাছে গরুর মাংস আছে, এমন অভিযোগে একাধিক হামলার ঘটনার পর ট্রেনে ভ্রমণ করা মুসলমানদের আচরণে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। রীমা আহমেদ বলেন, ‘এখন, আমরা সবাই সতর্ক থাকি, গণপরিবহনে চলাচল করার সময় আমিষ জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলছি বা সম্ভব হলে গণপরিবহনে এসব বহন করা সম্পূর্ণভাবে বাদ দিচ্ছি।’
আগ্রার সপ্তম প্রজন্মের একজন বাসিন্দা কলিম আহমেদ কোরেশি যিনি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার থেকে গহনার নকশাকার এবং সঙ্গীতশিল্পী হয়ে উঠেছেন, যিনি শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোও ঘুরিয়ে দেখান।
তিনি সবসময় ‘রুবাব’ নামে দোতারার মতো একটি বাদ্যযন্ত্র বহন করতেন, সাধারণত আফগানিস্তানে এ ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজানো হতো।
সম্প্রতি দিল্লি থেকে আগ্রায় যাওয়ার সময় একজন হিন্দু সহযাত্রীর সাথে শেয়ারে ট্যাক্সি ভাড়া করেন। তিনি বলেন, ‘যখন তিনি রুবাবের কেইসটা দেখেন, তিনি আমাকে এটি খুলতে বলেছিলেন, তার ভয় ছিল এটি বন্দুক কি না। আমি বুঝতে পেরেছি যে আমার মুসলিম নামের প্রভাবে তিনি এ ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখনও আমাকে সেই উদ্বেগ নিয়ে চলতে হয়। এখনও যখন আমি ভ্রমণ করি, আমি কোথায় আছি, আমি কী বলছি, কী করছি সে সম্পর্কে আমাকে খুব সচেতন থাকতে হয়। এমনকি ট্রেনে টিকিট চেকারের কাছে নিজের নাম প্রকাশ করতে গেলেও আমার অস্বস্তি লাগে।’
কুরেশি এর গভীরে একটি স্পষ্ট কারণ দেখতে পান: ‘বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল, রাজনীতি তার মধ্যে বিষ মিশিয়ে দিয়েছে।’
‘মুসলমানদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই,’ বিজেপির জাতীয় পর্যায়ের একজন মুখপাত্র সৈয়দ জাফর ইসলাম, দিল্লিতে সম্প্রতি এক উষ্ণ বিকেলে আমাকে এ কথা বলেন। ক্রমবর্ধমান ইসলামফোবিয়ার পেছনে দায়িত্বহীন মিডিয়া হাউসগুলোকে দায়ী করেন তিনি।
‘কোথাও ছোট ঘটনা ঘটলেই গণমাধ্যম এমনভাবে বাড়িয়ে প্রচার করে যেন এমনটা আগে কখনও ঘটেনি। ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বা একটি সম্প্রদায়ের ভেতরে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে,’ তিনি বলেন।
তার দাবি, ‘আপনি একটি বা দুটি ঘটনা দিয়ে পুরো পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিতে পারবেন না (এবং ক্ষমতাসীন দলকে মুসলিম বিরোধী বলতে পারেন না)। কেউ যদি একে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লক্ষ্যবস্তু হিসাবে চিত্রিত করে তবে তারা ভুল।’
আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তার বাচ্চারা স্কুল থেকে বাড়িতে এসে যদি বলে, তার সহপাঠীরা তাকে পরিবারিক ধর্মের জন্য ‘পাকিস্তানি সন্ত্রাসী’ বলে আখ্যা দিয়েছে- সে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে?
ভারতের এই সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ২০১৪ সালে বিজেপি পার্টিতে যোগ দেন, তার দুটি সন্তান রয়েছে, যার মধ্যে একজন স্কুলে পড়ছেন। তিনি ওই প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘অন্য অভিভাবকদের মতো আমারও খারাপ লাগবে। এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করা স্কুলের দায়িত্ব। অভিভাবকদের উচিত তারা যেন এমন কথা না বলে।’
যে দেশে ৭৯ শতাংশ মানুষ হিন্দু, সেখানে বিজেপি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে, এ বিষয়ে কী বলবেন? আলম বলেন, ‘মানুষ জানে এটা কথার কথা। আমাদের সরকার বা দল কী এমন কথা বলেছে? যারা এই ধরনের কথা বলে তাদেরকে গণমাধ্যম এত জায়গা কেন দেয়? মিডিয়া যখন এমন লোকদের জায়গা দেয় তখন আমরা বিরক্ত হই।’
কিন্তু তারপরও, ভারতের পার্লামেন্টে মুসলিম প্রতিনিধিত্বের অভাব নিয়ে কী বলবেন? বিজেপির কোনো মুসলমান মন্ত্রী, পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে কোনো মুসলমান এমপি নেই। দেশব্যাপী স্থানীয় বিধানসভার সদস্য বা এমএলএ এক হাজার জনের বেশি হলেও এরমধ্যে মাত্র একজন মুসলমান সদস্য রয়েছেন।
বিজেপির সাবেক এমপি আলম স্বয়ং বলেছেন, এটা ইচ্ছাকৃত নয়। তার ভাষায়, ‘বিজেপিকে পরাজিত করার জন্য কংগ্রেস এবং অন্যান্য বিরোধী দলগুলো তাদের এজেন্ডা পরিবেশন করতে মুসলমানদের ব্যবহার করছে। যদি কোনো দল কোনো মুসলমান প্রার্থীকে প্রার্থিতা দেয় এবং মুসলমানরা তাকে ভোট না দেয় তবে কোন দল তাকে টিকিট দেবে?’
এটা সত্য যে ভারতের মাত্র আট শতাংশ মুসলমান ২০১৯ সালে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল, এবং তারা ক্রমেই একজোট হয়ে মোদির দলের বিরুদ্ধে ভোট দিচ্ছে।
২০২০ সালের বিহার রাজ্য নির্বাচনে, একটি বিজেপি-বিরোধী জোটকে ৭৭ শতাংশ মুসলমান সমর্থন দিয়েছিল; ২০২১ সালে, ৭৫ শতাংশ মুসলমান পশ্চিমবঙ্গে আঞ্চলিক তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থন করেছিল; এবং ২০২২ সালে, ৭৯ শতাংশ মুসলমান উত্তর প্রদেশে বিরোধী সমাজবাদী পার্টিকে সমর্থন করেছিল।
কিন্তু আলম যুক্তি দেন, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলগুলো তাদের অনুগত থাকার জন্য মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘ভয় ও উদ্বেগ’ জাগিয়েছে। অন্যদিকে মোদি সরকার ‘(কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে) পার্থক্য করে না’।
‘কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলো সব মানুষের কাছে পৌঁছেছে। কিছু কিছু প্রকল্পের সবচেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করছেন মুসলমানরা। গত ১০ বছরে কোনো বড় দাঙ্গা হয়নি।’
প্রকৃতপক্ষে ২০২০ সালে একটি বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে দিল্লিতে দাঙ্গায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল, যাদের বেশিরভাগই মুসলমান- কিন্তু ভারত স্বাধীনতার পর থেকে বেশ কয়েকবার আরও খারাপ পরিস্থিতি দেখেছে। আলম মূলধারা থেকে নিজেকে দূরে রাখার জন্য মুসলমান সম্প্রদায়কে দায়ী করেছেন।
তার দাবি, ‘মুসলমানদের অবশ্যই নিজেদের চিন্তা ও অনুভূতির বিশ্লেষণ করতে হবে। তাদের উচিত হবে নিজেদের নিছক ভোটব্যাংক বিবেচিত হওয়াকে প্রত্যাখ্যান করা এবং ধর্মীয় নেতাদের দ্বারাও তাদের প্রভাবিত হওয়া উচিত নয়। মোদি সমাজকে একত্রিত করার জন্য কঠোর চেষ্টা করছেন যাতে মানুষ সুখে শান্তিতে সহাবস্থান করে এবং তারা বিভ্রান্ত না হয়।’
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি মোদির নেতৃত্বে ভারতের মুসলমানদের ভবিষ্যত কেমন দেখেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা খুব ভালো…. ধীরে ধীরে মানসিকতা বদলাচ্ছে। আরও মুসলমান বিজেপিতে যোগদান করবে। সবকিছু ভালোর দিকে যাচ্ছে।’
তবে সবকিছু আদৌ ভালোর দিকে যাচ্ছে কি না তা বলা মুশকিল। এটা সত্য যে, এই উত্তাল সময়ের মধ্যে, অনেক মুসলমান বলেছে যে তাদের সম্প্রদায় একটি সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
সালাম বলেন, নিজেদের বিষয়ে ভাবতে শুরু করেছে মুসলমানরা, তারা শিক্ষিত হয়ে উঠতে শুরু করেছে। দরিদ্র, চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীরা যাতে ঠিকমতো শিক্ষা পায়, সেজন্য সমন্বিতভাবে সহায়তা করছেন মুসলমান শিক্ষাবিদ এবং বুদ্ধিজীবীরা। নিজেদের উন্নতির এই চেষ্টা হয়তো প্রশংসা পেতে পারে, কিন্তু এর মাধ্যমে সরকারের প্রতি অবিশ্বাসের বিষয়টিও পরিষ্কার হয়ে যায়।
আরজু পারভীন তাদের মধ্যে একজন যিনি ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্য বিহারে থেকে শিক্ষার মাধ্যমে পরিবারের দারিদ্র্য থেকে মুক্তির পথ দেখতে পাচ্ছেন। তবে রীমা আহমেদের ছেলের মতো ধর্মীয় উত্তেজনা তার পথে প্রধান বাধা ছিল না, বরং তার নিজের বাবা কাঁচুমাচু হয়ে থাকেন যে অন্যরা কী ভাববে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে টাকা পয়সার সমস্যা আছে, আপনি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে, গ্রামের লোকেরা এটি নিয়ে কথা বলবে। আমি তাকে বলেছিলাম- আমরা এভাবে বাঁচতে পারি না। নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ দমিয়ে রাখতে পারি না।’
আরজু যখন জানতে পারেন তার মা কীভাবে স্থানীয় হাসপাতালে মারা গিয়েছেন, তখন থেকেই তার স্বপ্ন ডাক্তার হওয়া। গ্রামের শিক্ষকদের থেকে নারীদের ইঞ্জিনিয়ার ও ডাক্তার হওয়ার গল্প তাকে বিশ্বাস করিয়েছিল, এটাও সম্ভব।
‘আমি নয় কেন?’ তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেন এবং এক বছরের মধ্যে তিনি তার পরিবারের প্রথম নারী যিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। গ্রামের বাইরের পথে তিনি যখন পা বাড়ান তিনি কোনো রাষ্ট্রীয় অর্থে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হননি। তিনি ভর্তি হয়েছিলেন রাহমানি৩০ এ।
রাহমানি৩০ হলো সুবিধাবঞ্চিত মুসলমান শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অবৈতনিক বা বিনামূল্যের কোচিং স্কুল। যা ২০০৮ সালে একজন সাবেক রাজনীতিবিদ এবং শিক্ষাবিদ মাওলানা ওয়ালি রহমানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাহমানি৩০ এখন বিহারের রাজধানী পাটনাসহ তিনটি শহরে ছেলে মেয়েসহ ৮৫০ জন শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছে।
নির্বাচিত শিক্ষার্থীরা স্কুলের ভাড়া করা ভবনে বাস করে এবং ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিসিন এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সিতে জাতীয় ভর্তি পরীক্ষায় (ন্যাশনাল এন্ট্রেন্স এক্সাম) অংশগ্রহণ করে। তাদের মধ্যে অনেকেই প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী।
তাদের প্রত্যেকেই হয় ফল বিক্রেতার সন্তান, খামার শ্রমিক, কৃষক, দিনমজুর বা নির্মাণ শ্রমিকের ছেলে-মেয়ে। প্রায় ছয়শ জন সাবেক ছাত্র ইতোমধ্যে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট এবং অন্যান্য পেশায় কাজ করছে। তাদের মধ্যে ছয়জন চিকিৎসকও হয়েছেন।
পরের বছর, আরজু ২০ লাখেরও বেশি প্রতিযোগীর সাথে ভর্তি পরীক্ষার লড়াইয়ে যোগ দেবে। প্রতিবছর ভারতের ৭০৭টি মেডিকেল কলেজ যে ১ লাখ বিজোড় আসনে ভর্তি করায় তার একটি পেতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে আরজু।
তিনি বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত। আমি একজন গাইনোকোলজিস্ট হতে চাই।’
মোহাম্মদ শাকির রহমানি৩০ -এ শিক্ষাকে তার উন্নত জীবনের টিকিট হিসেবে দেখেন – যার মাধ্যমে তিনি তার সংগ্রামী পরিবারের দেখভাল করতে পারবেন। গত এপ্রিলে, ১৫ বছর বয়সী এই কিশোর তার বন্ধুদের সাথে পাটনা যাওয়ার জন্য বাসে চড়ে বসেন।
ছয় ঘণ্টার যাত্রাপথে তারা এমন একটি জেলা অতিক্রম করছিল যেখানে একটি হিন্দু উৎসবের শোভাযাত্রায় ধর্মীয় দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা এক বোতল পানি এবং কয়েকটি খেজুর নিয়ে যাত্রা করেছিল, একটি মসজিদে রাত্রি যাপন করেছিল, রহমানি৩০ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসেন এবং উত্তীর্ণ হন।
‘আমার বাবা-মা খুব ভয় পেয়েছিলেন, তারা বলেছিলেন- আমি যেন ওদিকে না যাই। আমি তাদের বলেছিলাম, ‘এখনই সময়। আমি যদি এখন না যাই, আমি জানি না আমার ভবিষ্যত কী হবে,’ বলেন শাকির।
এই কিশোরের জন্য, যে একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখে, তার ওপর ধর্মীয় উত্তেজনার ভয় তেমন ভর করতে পারেনি।
‘আমি আমার মাকে বলেছিলাম- আমি পরীক্ষার পর ফিরে আসব। পথে আমার কিছুই হবে না। এত কিছুর পরেও কেন কিছু ভুল হবে? আমার গ্রামে হিন্দু-মুসলমানরা মিলেমিশে একসাথে বসবাস করে।’
তাহলে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশে ভারতে মুসলমানদের ভবিষ্যত কেমন হবে?- যারা নিজেরাই শ্রেণি, গোষ্ঠী, বর্ণ এবং ধর্মীয় মতাদর্শে বিভক্ত।
সালাম ‘দীর্ঘমেয়াদী ভীতি’ বোধ হওয়া নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘মানুষ, মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য চাকরির অভাব এবং মুদ্রাস্ফীতির কথা বলে। কিন্তু এটা শুধু মুদ্রাস্ফীতি এবং কর্মসংস্থানের বিষয় নয়। এটা জীবনের অধিকারের কথা।’
তরুণ মুসলমানদের সাম্প্রতিক স্মৃতিকথা একই ধরনের ভয়ের কথা বলে।
‘প্রায় সবাই এমন একটি দেশ বেছে নিয়েছে যেখানে তারা যখনই অনিবার্য কিছু ঘটবে তখনই তারা সেখানে ছুটে যাবে। কেউ কেউ কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক বা যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী চাচাদের সাথে যোগাযোগ করেছে, যদি তাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন হয়।’
‘এমনকি আমার মতো কেউ, যারা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সময়েও নিরাপদ বোধ করে, এখন তারাও তাদের জন্মভূমিতে নিজেদের পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন,’ জেয়াদ মাসরুর খান তার সাম্প্রতিক বই ‘সিটি অন ফায়ার: আ বয়হুড ইন আলিগড়ে’ এসব কথা লিখেছেন।
আগ্রায়, রীমা আহমেদও ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন, ‘শুরুতে আমি ভেবেছিলাম এটা মুসলমানদের পেটানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং এ‌ সময়টা কেটে যাবে। এটা ১০ বছর আগের কথা। এখন আমার মনে হয় অনেক কিছু একদম হারিয়ে গিয়েছে আর নষ্ট হয়ে গিয়েছে।’ বিবিসি বাংলা