উপকূলের নারী শ্রমিকরা পুরুষের সমান কাজ করেও মজুরি পান অর্ধেক

0
16

উৎপল মণ্ডল, শ্যামনগর
আজ মহান মে দিবস। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিন। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের শ্রমিকেরা ১০ থেকে ১২ ঘণ্টার কর্মদিবসের বিপরীতে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছিলেন। সেই আত্মদানের পথ ধরেই পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রমজীবী মানুষ ন্যায্য মজুরি, অবকাশ, মানবিক আচরণ, স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ কর্মপরিবেশের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। অনেক দেশেই শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টার কর্মদিবসের দাবি পূরণ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের অন্য নারী শ্রমিকদের মতো উপকূলের নারী শ্রমিকরা রয়েছেন আজও পিছিয়ে।পুরুষের সমান কাজ করেও অর্ধেক মজুরি পান উপকূলের নারী শ্রমিকরা। নারী-পুরুষ একইসঙ্গে একই কাজ করে পুরুষের তুলনায় কম কাজ না করেও উপকূলের নারীরা মজুরি বৈষম্যে ভুগছেন। তারা তাদের অধিকার ও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপকূলীয় এলাকায় পুরুষের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরা কাঁকড়ার খামার, মাছের ঘের, নদীতে রেণু আহরণ, সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরা, রাজমিস্ত্রির সহকারী, মাটিকাটা, গ্রামীণ রাস্তানির্মাণ ও সংস্কার, কৃষিকাজ করে থাকেন। তবে এসব নারী শ্রমিকরা মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। উপকূলীয় এলাকায় দিনমজুরের চাহিদা অনেক বেশি। কিন্তু শ্রমিক সংকটের কারণ এই এলাকার অধিকাংশ পুরুষ শ্রমিকরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইট ভাটাসহ গ্রাম ছেড়ে শহরে কাজে চলে যান। এজন্য শ্রমিক সংকট কাটাতে এবং স্বল্প মূল্যে শ্রমিক পেতে হতদরিদ্র নারী শ্রমিকদের বেছে নেন কৃষকসহ এই এলাকায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন কাঁকড়া হ্যাচারি, মৎস্য প্রকল্পে। তবে নারীদের পুরুষ শ্রমিকদের অর্ধেক মজুরি দিচ্ছেন তারা। নারী শ্রমিকরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোদে পুড়ে কাজ করছেন। কিন্তু পুরুষের সমান কাজ করেও নারী শ্রমিকরা মজুরি পান অর্ধেক।সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের ধুমঘাট এলাকার ধানক্ষেতে ধান কেটে মাড়াই করার কাজ করা শ্রমিকের প্রায় অর্ধেকই নারী। একজন পুরুষ শ্রমিক দৈনিক ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা মজুরিতে কাজ করছেন। একই কাজ করে একজন নারী শ্রমিক মজুরি পাচ্ছেন ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। সমান কাজ করেও অর্ধেক মজুরি পাওয়ায় নারী শ্রমিকরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এ বৈষম্য লাঘবের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। সেখানে কাজ করা নারী শ্রমিক কুলসুম আক্তার বলেন, স্বামীর আয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হয়। তাই স্বাবলম্বী হতে আমিও ধান খেতে কাজ করছি। কিন্তু পুরুষের সমান কাজ করেও দিন শেষে অর্ধেক মজুরি পাচ্ছি। এটা অত্যন্ত কষ্টের। এ মজুরি বৈষম্য নিরসনের দাবি জানাচ্ছি। সোনাখালী গ্রামের নারী শ্রমিক সালেহা বেগম বলেন, একই সময়ে একই কাজ করে অর্ধেক মজুরি পাই। যখন মজুরি নিই তখন অনেক খারাপ লাগে। চাষি রফিকুল ইসলাম বলেন, ১০ বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেছিলাম। এখন ধান কাটে ঘরে তোলার সময় এসেছে এজন্য আমরা জমিতে প্রতিদিন ৮ জন শ্রমিক কাজ করছে। পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরাও কাজ করছে।তিনি আরও বলেন, পুরুষ শ্রমিকদের দৈনিক ৫৫০ টাকা এবং নারী শ্রমিকদের ৩০০ টাকা মজুরি দেই। উপজেলার দাতিনাখালি বনজীবী নারী উন্নয়ন সংগঠনের পরিচালক শেফালী বেগম। তিনি বলেন, এই অঞ্চলে অধিকাংশ পুরুষ সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। আগে বছরে তিন মাস সুন্দরবনে প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা থাকতো কিন্তু বর্তমানে ছয় মাস থাকে। সে কারণে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের কাজ করতে হয়। না হলে তাদের সংসার চলে না। তিনি আরও বলেন, এই অঞ্চলে অধিকাংশ নারীরা কাঁকড়া খামারে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। কিছু নারী মাছের ঘেরে, নদীতে রেণু আহরণ, সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরা, রাস্তা সংস্কার ও কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। তাদের বাড়ির কাজ করতে হয় পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে সমান বা তার চেয়ে বেশি কাজ করতে হয়। এরপরও পুরুষ যে মজুরি পায়, নারী পায় তার অর্ধেক। রাস্তা সংস্কারের কাজে একজন পুরুষ ৫০০ টাকা পেলে নারীকে দেওয়া হয় ৩০০ টাকা।এই এলাকার অধিকাংশ নারী তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়। কর্মপরিবেশ, কর্মঘণ্টা বিষয়ে অধিকাংশই জানেন না। অনেকে জানলেও কাজ হারানোর ভয়ে এ বিষয়ে মুখ খুলতে চান না। সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা সম অধিকারের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছি। শ্যামনগর উপজেলা জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান মিসেস শাহানা হামিদ বলেন, পুরুষের পাশাপাশি নারীও অর্থনীতির চালিকাশক্তি। তাদের পেছনে রেখে উন্নয়ন অগ্রযাত্রার কথা ভাবা যায় না।তিনি আরও বলেন, নারী-পুরুষদের মজুরি বৈষম্য থাকলে নারীরা কাজে অনুৎসাহী হবেন এবং দেশ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে যাবে। তাই মজুরি বৈষম্য নিরসনে প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে। শ্যামনগর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শারিদ বিন শফিক বলেন, সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপকূলীয় এ এলাকায় নারী শ্রমিক বেড়েছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও পরিবারের উন্নয়নে এগিয়ে আসছে। তবে এখানে নারী শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্য রয়ে গেছে। নারীদের মজুরি বৈষম্য নিরসনে নারীরা যেন তাদের নায্য মজুরি পায় সে বিষয়ে মালিক ও শ্রমিকদের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে সচেতনতা কার্যক্রম করা হয়। এছাড়া নারীর সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনিসহ সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার কাজ করে যাচ্ছে। শ্যামনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ নাজমুল হুদা বলেন, পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরা মাঠে কাজ করছেন এটা ভালো লক্ষণ। দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে হলে নারী-পুরুষ সমানতালে এগোতে হবে। তবে কোনোভাবেই মজুরি বৈষম্য করা যাবে না। এতে নারী শ্রমিকরা কাজের উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন।