স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও পরিবারতন্ত্র, দুর্বল হচ্ছে আওয়ামী লীগ

0
15

প্রতিদিনের ডেস্ক
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর শ্যালক কামাল, স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর ভাতিজা আমিরুল ও শ্যালক মহব্বত, একরাম চৌধুরীর ছেলে শাবাব, শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খান, আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর ছেলে আশিক আব্দুল্লাহ ও গোলাম দস্তগীর গাজীর ছেলে গোলাম মর্তুজা পাপ্পা টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। সরকারে ব্যস্ত দলটির শীর্ষ নেতারা। কর্মীবিমুখ নেতাদের আত্মীয়নির্ভরতা, ‘মাইম্যান’ তৈরির চেষ্টায় ক্রমশ দূরে সরছেন দুর্দিনের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। আস্থার সংকটে ভেঙে পড়ছে চেইন অব কমান্ড। দুর্বল হচ্ছে সংগঠন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দলের মধ্যে নীরব এই ক্ষয় টের পাওয়া যাবে সংকট বা আসন্ন নির্বাচনে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘পরিবারতন্ত্র’ থেকে বের হতে পারেনি ক্ষমতাসীনরা। সম্প্রতি টানা চার ধাপের উপজেলা নির্বাচনেও মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের স্বজনদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। বেশিরভাগ উপজেলায় এমপি-মন্ত্রী ও নেতাদের স্বজন বা নিজস্ব বলয়ের লোকদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বঞ্চিত হচ্ছে দীর্ঘদিন সংগঠন করা ত্যাগী ও জনপ্রিয় নেতারা।
অনেক জায়গায় স্বজন না থাকলেও নিজের বলয়ের লোকদের মনোনয়ন দিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাস করিয়ে নিয়েছেন অনেক এমপি-নেতা। এ নিয়ে সমালোচনা ওঠায় নির্বাচন মন্ত্রী-এমপির প্রভাবমুক্ত রাখতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ স্বজনদের সরে যেতে বলেছে। যদিও এটিকে থোড়াই কেয়ার করছেন এলাকাগুলোতে ব্যক্তি সাম্রাজ্য গড়ে তোলা এমপি-মন্ত্রীরা। মাত্র তিনজন ছাড়া কেউই মানেননি এ নির্দেশনা।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বলছেন, ক্রমে তৃণমূলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী বলে কিছু থাকছে না। নেই সংগঠনেরও গুরুত্ব। বেশিরভাগ জায়গায় নতুন মুখ বা হাইব্রিডদের দাপটে নেতাকর্মীরা হয় নীরব, না হয় দল থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। আত্মীয় ও ‘মাইম্যান’ প্রতিষ্ঠা করতে দলীয় নেতাদের এই অভিমানে আরও সুযোগ নেন এমপি-মন্ত্রীরা। নতুন বা হাইব্রিডদের দিয়ে দল সাজান। ক্ষমতার ভাগ পায় স্বজন ও ‘মাইম্যানরা’।
এই পরিস্থিতিতে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কি না জানতে চাইলে সংগঠনটির নেতারা বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত তো হচ্ছেই। যার কারণেই তো মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনদের নির্বাচন থেকে সরে যেতে বলা হয়েছে। এখন এটি না মানলে নিশ্চয়ই দল ব্যবস্থা নেবে।’ তবে দলের এ ক্ষতি ফের নির্বাচন এলে টের পাবে বলেও জানান কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতারা।
কুমিল্লার বরুড়া উপজেলায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের শ্যালক হামিদ লতিফ ভুইয়া কামাল নির্বাচন করছেন প্রয়াত এমপি ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান এ এম এম মইনুল ইসলামের বিরুদ্ধে। হামিদ লতিফ ভুইয়া কামালের কোনো দলীয় পরিচয় পাওয়া যায়নি। উপজেলা নির্বাচনের আগে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয়ও ছিলেন না। এখনো নেই। পুলিশ প্রশাসনও তাকে সহযোগিতা করছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
একইভাবে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল (লোটাস কামাল) এমপির ভাই গোলাম সরওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। লোটাস কামালের অবর্তমানে তিনিই ওই এলাকার মা-বাপ। পাশের লাকসাম উপজেলায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম এমপির শ্যালক মোহাব্বত আলী ও মনোহরগঞ্জে মন্ত্রীর ভাতিজা আমিরুল ইসলাম ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। লাকসাম ও মনোহরগঞ্জের দল ও সরকার চালান মন্ত্রীর এই দুই স্বজন। মন্ত্রীর ভয়ে এ নিয়ে কেউ মুখও খোলেন না।
জেলার দেবিদ্বার উপজেলায় স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদের ছোট ভাই মো. মামুনুর রশিদ মামুন চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মুরাদনগর উপজেলায় স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর আলম সরকারের ছেলে ড. আহসানুল আলম সরকার কিশোর পুনরায় চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বি-পাড়া উপজেলায় স্থানীয় সংসদ সদস্য আবু জাহেরের ভাতিজা আবু তৈয়ব অপিও চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। হোমনা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে পুনরায় চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন এমপিপত্নী রেহানা মজিদ।
নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায় আলোচিত সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে শাবাব চৌধুরী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন প্রবীণ রাজনীতিক ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ খায়রুল আনম চৌধুরীর সঙ্গে। একরাম চৌধুরীর অর্থ ও পেশিশক্তির কাছে অসহায় খোদ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।হাতিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর ছেলে আশিক আলী অমি। এখানে ভাইস চেয়ারম্যান পদেও একাধিক প্রার্থী নেই।
নোয়াখালী-৩ আসনের সংসদ সদস্য মামুনুর রশিদ কিরণের ছেলেও উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী। চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদে লাভলী চৌধুরী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর মায়ার ভাতিজা বউ।মুন্সিগঞ্জ-৩ এর সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লবের চাচা আনিসুজ্জামান সদর উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী। তার বাবা মোহাম্মদ মহিউদ্দিন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।
নরসিংদী-২ এর সংসদ সদস্য আনোয়ার আশরাফ খানের শ্যালক মো. শরিফুল হক পলাশ উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী, মাগুরা-২ আসনের সংসদ সদস্য বীরেন শিকদারের ছোট ভাই বিমল শিকদার উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী, মাদারীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য শাহজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খান উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী, বগুড়া-১ আসনের সংসদ সদস্য শাহদারা মান্নানের ভাই এক উপজেলায় এবং ছেলে অন্য উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী, সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য এম এ মান্নানের ছেলে শাহাদাত মান্নান শান্তিগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী।
মানিকগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ মালেকের ফুফাতো ভাই ইসরাফিল হোসেন উপজেলা সদরের চেয়ারম্যান প্রার্থী, কুষ্টিয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহবুবউল আলম হানিফের চাচাতো ভাই আতাউর রহমান সদর উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী, পাবনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য হাজি মো. মকবু্লের বড় ছেলে ভাঙ্গুড়া উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী, পাশাপাশি ছোট ছেলে আশিককে পৌরসভার চেয়ারম্যান প্রার্থী করতে চান তিনি। পিরোজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য শ ম রেজাউল করিমের ছোট ভাই নূর ই আলম নাজিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী, বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছোট ছেলে আশিক আব্দুল্লাহ আগৈলঝাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী, টাঙ্গাইল-১ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাকের খালাতো ভাই ধনবাড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী, নারায়ণগঞ্জের এমপি ও সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর ছেলে গোলাম মর্তুজা পাপ্পা রূপগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
দলের সিদ্ধান্ত মেনে এরই মধ্যে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন নাটোর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের শ্যালক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এমপি ক্যাপ্টেন (অব.) এবি তাজুল ইসলামের ভাগনে এবং চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলী আজগর টগরের ভাই আলী মনসুর বাবু।
সাবেক ছাত্রনেতা ও টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী মেহেদী হাসান রনি বলেন, ‘আমার প্রতিদ্বন্দ্বী এমপির আপন খালাতো ভাই ও মামাতো ভাই। দল থেকে নির্দেশনা দেওয়ার পরও তারা মানেনি। বরং নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করছেন। এমপিও তাদের পক্ষে কাজ করছেন। সব যদি মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়-স্বজনরাই হয়, আমরা যারা ছাত্র রাজনীতি করে আসছ। তারা কোথায় যাবো?’
কুমিল্লা বরুড়া উপজেলার পয়ালগাছা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শান্তি রঞ্জন দাস বলেন, ‘রাজনীতি তো এখন আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই, পয়সাওয়ালাদের হাতে চলে গেছে। বেশিরভাগ জায়গায় পয়সাওয়ালারা নেতৃত্বে এসে উপজেলা ইউনিয়নে আধিপত্য ধরে রাখতে ত্যাগী ও জনপ্রিয় নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে পরিবারের সদস্য ও ‘মাইম্যান’ বসান। জনপ্রতিনিধি করেন। সব ক্ষমতার ভাগ পায় স্বজন ও ‘মাইম্যান’। রাগে ক্ষোভে অভিমানে দূরে সরে যায় দুঃসময়ের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদেরও দেখি নিজের স্বজনদের প্রাধান্য দিচ্ছেন। তাহলে অন্যরা কী শিখবে?’
এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, ‘যারা দলীয় নির্দেশ মানবে না বা মানছে না, দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় এটি আলোচনা হবে। এ নিয়ে নেত্রীর কাছ থেকে একটি দিকনির্দেশনা পাবো বলে আশা করছি।’
দলের ক্ষতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কি না, এটা এখন বলা যাবে না। আরেকটা নির্বাচন এলে বোঝা যাবে। তবে এ নিয়ে আমরা একটি সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।’
দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘দল তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং ত্যাগী ও জনপ্রিয় নেতাদের বঞ্চিত না করার জন্যই তো এমপি-মন্ত্রীদের স্বজনদের নির্বাচনে প্রার্থী হতে নিষেধ করা হয়েছে। যারা সরছে না তারা দলের আদেশ মানছে না। যারা দলের আদেশ মানবে না, তাদের কর্মকাণ্ডকে ভালোভাবে দেখার কোনো কারণ নেই। এটি নিশ্চয়ই দল মূল্যায়ন করবে। আগামীতে কী করা যায়, কঠোর কোনো ব্যবস্থায় যাবে কি না, নেত্রী আসার পর আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘বিষয়টি অনেক দিন ধরেই তৃণমূলে আলোচিত হচ্ছে। ওপরের পর্যায়েও কমবেশি কথাবার্তা হয়েছে এ বিষয়ে। কিন্তু বর্তমানে এটি সহনীয় মাত্রা অতিক্রম করেছে। ফলে শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে মন্ত্রী-এমপিদের সন্তান, স্ত্রী, ভাই, বোন, শ্যালক এবং নিকটাত্মীয়দের প্রার্থী না হওয়ার জন্য বলা হয়েছে। এর অন্য দিকটি হলো, কোনো মন্ত্রী-এমপি যেন অতি উৎসাহী হয়ে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে না পারেন, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘যারা দলের নির্দেশ অমান্য করবেন তারা অবশ্যই শাস্তির আওতায় আসবেন। তবে, আওয়ামী লীগে ‘বহিষ্কার করিলাম, প্রত্যাহার করিলাম’ এমন কোনো সংস্কৃতি বা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নেই। আওয়ামী লীগের গঠণতন্ত্র অনুযায়ী কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি যে শাস্তি নির্ধারণ করবে সে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হবে।’