চ্যালেঞ্জের নির্বাচন ও বিএনপির অস্তিত্ব

0
29

ড. মিল্টন বিশ্বাস
একসময় জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘‘আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট’’। অর্থাৎ তিনি রাজনীতি কঠিন করে দেবেন।প্রকৃতপক্ষে তাঁর দেওয়া বিধি-নিষেধের খপ্পরে পড়েছিল দেশের রাজনীতি। আর তিনি নিজে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’(বিএনপি)নামকরণ করে যে দলের জন্ম দিয়েছিলেন তা ২০২৪ সালে অবলুপ্তির ইতিহাসকে ধারণ করতে যাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করেন।
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকার রমনা রেস্তোরাঁ প্রাঙ্গনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউর রহমান বিএনপির প্রধান হিসেবে দলের নাম, গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন।তিনি রাজনীতিতে এসেছিলেন সামরিক বাহিনী থেকে।লেখক-গবেষক মহিউদ্দীন আহমদের ‘বিএনপি সময়-অসময়’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বিএনপি এমন একটি দল, যার জন্ম স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। এই অঞ্চলে সব দলের জন্ম হয়েছে ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে, রাজপথে কিংবা আলোচনার টেবিলে। বিএনপি সেদিক থেকে ব্যতিক্রম। দলটি তৈরি হলো ক্ষমতার শীর্ষে থাকা একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তির দ্বারা, যিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি রাজনীতি করবেন।’
‘একজন অরাজনৈতিক’ ব্যক্তি যিনি সামরিক উর্দি দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও জনসমর্থন আদায় করে নিয়েছিলেন এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে যার সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়েছে, সেই খুনি জিয়ার দল আজ অপরাজনীতির পথে হাঁটছে।কিন্তু বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ বিএনপি নামক দলটির সহিংসতা, আগুন সন্ত্রাস আর দেশবিক্রির চক্রান্ত রুখে দিয়ে ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সফল করে তুলেছে।এজন্য অনেকেই অনুসন্ধিৎসু মনে জিজ্ঞাসা ছুড়ে দিয়েছে-‘ নির্বাচনের পরে রাজনীতি কোন পথে?’
বলাবাহুল্য, ৭ জানুয়ারির পর বিএনপি বলে কোনো দলের অস্তিত্ব থাকবে বলে আমরা মনে করি না। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করছে না। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ২৮ টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে।সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং গণতন্ত্র সুরক্ষার জন্য এই নির্বাচনের কোনো বিকল্প ছিল না।এজন্য উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হতে চলেছে।
বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে আপসোস করেছে। ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বরে দৈনিক ভোরের কাগজে মির্জা ফখরুলের সাক্ষাৎকারে সে সত্য প্রকাশিত হয়েছে।২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও তারেক জিয়ার টাকার বিনিময়ে প্রার্থী মনোনয়নের অভিযোগ ও দলটির নেতৃত্বের কোন্দল ভয়ঙ্করভাবে আত্মপ্রকাশ করে। এজন্য ভোটের ফলাফলে তারা পরাজিত হয়। দলের সাংগঠনিক দক্ষতা না থাকায় নেতা-কর্মীরা সংঘবদ্ধ হতে ব্যর্থ হয়েছে একাধিক জাতীয় ইস্যুতে।একইভাবে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করতে পারে নি তারা। বিএনপি নামক বিরোধীদল চেষ্টা করেছিল যেন শেষ পর্যন্ত নির্বাচন না হয়, একটি অরাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতা দখল করে, আন্তর্জাতিক মহল যেন নির্বাচন বন্ধে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি। বরং সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে সরকার একটি নির্বাচন আয়োজন করতে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। এরকম বাস্তবতায় নির্বাচনের পরে দেশের রাজনীতি বিএনপি’র টিকে থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক।
বিএনপি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে সহিংসতা ও অগ্নিসন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে যে অপতৎপরতা শুরু করেছিল তা নির্বাচনের পরে ৮ জানুয়ারি থেকে অব্যাহত রাখা অসম্ভব।কেউ কেউ বলছেন, ‘বিএনপি তাদের আন্দোলনের কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিতে পারে।এই আন্দোলনের কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।’ কিন্তু এসবই কষ্ট কল্পিত বিষয়। কারণ নির্বাচনের পরে গঠিত সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করেও তারা সুবিধা করতে পারবে না।অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেন সরকার স্বীকৃতি না পায়, এই সরকার যেন বিভিন্ন দেশের কাছে অবৈধ এবং অগ্রহণযোগ্য সরকার হিসেবে পরিচিতি পায় সেটার জন্য বিএনপি চেষ্টা করেও কিছু অর্জন করতে সক্ষম হবে না।
আসলে সংবিধান সম্মতভাবে একটি নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর সরকার স্বীকৃতির সংকটে ভুগছে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। কাজেই বিএনপির এই ধরনের উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে সেটা লেখাবাহুল্য। বরং নির্বাচনের আগে বিএনপি সারা দেশে যেভাবে সন্ত্রাস, সহিংসতা এবং নাশকতা করেছে সেই ধারা তারা যদি অব্যাহত রাখে তাহলে দেশে একটি অস্থিতিশীল এবং অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টির পাঁয়তারা করে নিজেদের ধ্বংস নিজেরা ডেকে আনবে।২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনোত্তর পেট্রোল বোমা সন্ত্রাসীরা যেভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল সেই কঠোর আইনি শাসনের মধ্যে পড়ে বিএনপি বিলুপ্ত হবে।সরকার গঠনের পর কঠোরভাবে সন্ত্রাস এবং অপরাজনীতি দমন করবে- এটাই স্বাভাবিক।কারণ নতুন সরকারের হাতে পুরোপুরি ম্যান্ডেড থাকবে এবং এই ম্যান্ডেড অনুযায়ী তারা যেকোনো বিশৃঙ্খল তৎপরতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম হবে।
নির্বাচন শেষ হওয়ার পর দেশের জনগণের কাছে জ্বালাও-পোড়াওহীন একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের প্রত্যাশা থাকবে।রাজনৈতিক সংঘাত সহিংসতা নির্বাচনের পরে বেশিদিন থাকুক এটা কেউই চায় না।জনগণ স্বাভাবিক জীবন চায়।এজন্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন যে সরকার গঠিত হবে সেই সরকার রাজনীতির বিশৃঙ্খল পরিবেশ, সন্ত্রাস, অগ্নিসংযোগ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে দেশকে একটি সুস্থ রাজনৈতিক ধারায় নিয়ে আসার চেষ্টা করবে বলেই সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করে। নির্বাচনের পরে রাজনৈতিক গতি প্রবাহ কীভাবে এগোয় তার ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের অগ্রগতি এবং উন্নয়ন অভিযাত্রার পরবর্তী পদক্ষেপগুলো।এক্ষেত্রে বিএনপি নামক সন্ত্রাসী দলের সহিংসতা-নাশকতা দূর হবে বলে সকলেই মনে করেন।
বিএনপি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে পৃথিবীর অনেক জায়গায় বসে শেখ হাসিনা সরকারের গত ১৫ বছরের উন্নয়ন ও অগ্রগতির চিত্রের কথা ব্যক্ত করার পরিবর্তে মিথ্যাভাষণে সরকার বিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত। এদের বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষকে সচেতন থাকতে হবে।যেমন, তারেক রহমানের কুখ্যাত হাওয়া ভবনের প্রেক্ষাপটে আনসারী একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সহকারী প্রেস সচিবের দায়িত্বও গ্রহণ করে। জাতিসংঘের আঙিনায় বসে শেখ হাসিনার বিরোধিতা করা এখন তার একমাত্র কাজ। অথচ বাংলাদেশের সরকার ধারাবাহিকভাবে একটি ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছিল তা সম্পন্ন হচ্ছে ৭ জানুয়ারি। অথচ বিএনপি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারেনি।
বাংলাদেশ দীর্ঘায়িত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে। তবে শেখ হাসিনা বর্তমানে রাজনৈতিক সমস্যা, ভূ-রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক বিষয়গুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে চলেছেন। ক্ষমতাসীন দলের কাছে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার গুরুত্বের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল ঠিকই কিন্তু মূল প্রশ্নটি হলো- বিরোধীরা নির্বাচন বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়ে কি পেল?নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে বিএনপি। কিন্তু আন্দোলন শুরুতে মুখ থুবড়ে পড়ে। আন্দোলনের কর্মসূচি জমিয়ে তুলতে পারেনি দীর্ঘ ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি।এজন্যই তারা সহিংসতা ও লবিস্ট নির্ভর দলে পরিণত হয়েছে।
একথা সর্বজনবিদিত যে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে একদিনে ৪৯৫ টি বোমাবাজি হয় দেশের ৬৪ জেলার ৬৩ টিতে এবং একই সময়ে। বোমাবাজির ফলে এজলাশে বিচারকের মৃত্যু ঘটে। ‘বাংলা ভাই’, ‘জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ’ (জেএমজেবি), ‘জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ’ (জেএমবি) এগুলোর কথা কেউ ভোলেনি।ব্রিটিশ হাইকমিশনার একটি মাজার সফরে গেলে সেখানেও বোমাবাজি হয়; হিন্দুদের অনেক বাড়িঘর ও নারীরা উগ্রবাদীদের আক্রমণের শিকার হয়। ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা এখনো জীবন্ত। সন্ত্রাস আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ফলে ২৪ জন মারা যান এবং প্রায় ৩৭০ জন আহত হন। কিন্তু প্রাণে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা এখনো আছেন বলে দেশে শান্তি ফিরে এসেছে, বোমাবাজি, সন্ত্রাস বন্ধ হয়েছে, ‘বাংলা ভাই’-দের অত্যাচার এখন নেই। এখন সন্ত্রাসীরা বা ধর্মীয় উগ্রবাদীরা বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থানের কারণে। কিছু কিছু ছোট ঘটনা রয়েছে, যেমন সীমান্তে হত্যা, গরু ব্যবসায়ীকে হত্যা- এগুলো যদি বন্ধ করা যায়, তাহলে স্থিতিশীলতা জোরদার হবে। সকলেই স্থিতিশীলতা চায়, বাংলাদেশও স্থিতিশীলতা কামনা করে। অন্যদিকে বিএনপি তা চায় না। সন্ত্রাসী দল বিএনপি নির্বাচনে বিশ্বাস করে না। নির্বাচন বানচাল করার জন্য ট্রেনে আগুন দেওয়া থেকে শুরু করে মানুষ পুড়িয়ে মারা, বোমা হামলা, ককটেল মারা, এসব জঘন্য কাজগুলো তারা করেছে।এজন্য তারা ঘৃণিত দলে পরিণত হয়েছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং নির্বাচন-উত্তর বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা যেন বজায় থাকে, তা নিশ্চিত করা। আর স্থিতিশীলতার প্রতীক হচ্ছেন শেখ হাসিনা। ৭ জানুয়ারি ভোট দিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘অনেক বাধা-বিপত্তি ছিল, কিন্তু দেশের মানুষ তাদের ভোটের অধিকারের বিষয় সচেতন হয়েছে। পাঁচ বছর পর নির্বাচন আসে জনগণ ভোট দেবে, সে নির্বাচনের ভোট দেওয়ার পরিবেশ আমরা তৈরি করতে পেরেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনটা অবাধ নিরপেক্ষ হবে। জনগণ যাকে খুশি তাকে ভোট দিক, নির্বাচন যাতে সুষ্ঠুভাবে হয় তার জন্য আমরা জনগণের সব ধরনের সহযোগিতা চাই।’ প্রকৃতপক্ষে তিনি সকলের আদর্শ, তিনি স্থিতিশীলতার শক্তি। বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে টিকিয়ে রেখেছে- মানুষ ভালোবেসে তাঁকে টিকিয়ে রাখবে ভবিষ্যতেও। কারণ বাংলাদেশের জন্য, এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় শেখ হাসিনার বিকল্প নেই।অন্যদিকে জঙ্গিবাদী দল হিসেবে বিএনপি আজ প্রত্যাখ্যাত।তাদের সহিংসতা এবং লবিস্ট অপতৎপরতা রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রতীক।আসলে বিএনপি বলে এদেশে কিছু থাকবে না, দলটির অবলুপ্তির সময় এসে গেছে।
লেখক : বঙ্গবন্ধু গবেষক এবং বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here