কবি আবুবকর সিদ্দিক: দ্রোহে-প্রেমে সারাজীবন

0
35

আমিনুল ইসলাম
তিরিশের পঞ্চপাণ্ডব দেখিয়ে দিলেন যে কবিতা শুধু স্বভাবকবির কাঁচা আবেগের ফসল নয়; প্রতিভাবানদের বুদ্ধিদীপ্ত চাষাবাদেরও উৎকৃষ্ট শস্য। ফলে যারা মেধাবী তারা এগিয়ে এলেন। তাঁদের হাতে রচিত হতে থাকলো বহুকথিত আধুনিক বাংলা কবিতা। আবুবকর সিদ্দিক সেই মেধাবী ও পরিশ্রমী কবিদের অগ্রগণ্য একজন। দক্ষিণবঙ্গের নদীজঙ্গলময় নিসর্গে তাঁর জন্ম। পশ্চিমবঙ্গে বাল্য-কৈশোর গুজরান। দেশ বিভাগের পর পুনরায় স্বভূমে প্রত্যাবর্তন। তারপর দক্ষিণবঙ্গ পরিভ্রমণ শেষ করে উত্তরাঞ্চল চষে বেড়ানো ভালোবাসার মন আর গভীর প্রত্যক্ষণের চোখ নিয়ে। এ সময়কালে পৃথিবীতে ঘটে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, উপমহাদেশে বিভক্তি, সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ও পতন, সামরিক শাসন, ভাষা আন্দোললন, গণ-অভূত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা লাভ এবং স্বাধীনতা-উত্তর ভয়ংকর হতাশা। এসব কিছুর চাক্ষুষ দর্শক আবুবকর সিদ্দিক। তিনি এ সবকিছুকে উপজীব্য করে তাঁর মেধাবী কলমে লিখে গেছেন প্রেম-প্রত্যাশা, দ্রোহ আর হতাশার উচ্চারণমালা। তবে শ্রেণিচেতনা আর নারীর প্রেম মূলত এই দুই প্রধান ভূখণ্ডে ভাগ হয়ে গেছে তাঁর কাব্যিক বিচরণ। কোন ভাগে কম আর কোন ভাগে বেশি তা নিরূপণ করাই মুশকিল।
কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর নিজ সম্পর্কে বলেছিলেন, না প্রেমিক না বিপ্লবী। আবুবকর সিদ্দিক প্রেমিক এবং সেই সঙ্গে বিপ্লবীও। শ্রেণিচেতনায় উদ্দীপিত যে মন তাঁকে দিয়ে লিখিয়েছে অজস্র আগুন ঝরানো গণসংগীত—সেই মনই একান্ত দুর্বল মুহূর্তের রোমান্টিক অবসরে তাঁকে রচতে বাধ্য করেছে প্রেমের পাণ্ডুলিপি। তিনি নিজেকে রবীন্দ্রনাথে সমর্পিত বলে দাবি করেছেন। কিন্ত তাঁর দ্বিমুখী পদাচরণা নজরুলীয় যার মূলমন্ত্র এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতুর্য। যৌবনের দুরন্ত আবেগে তিনি উচ্চারণ করেন ‘আমার রক্তের দাগে তবে লেখা থাক/ শপথ তোমার নামে দেশ’। আবার সেই কণ্ঠেই উচ্চারণ করেন সামজিক অনুশাসন উপেক্ষায় প্রেমের স্পর্ধিত পঙক্তিমালা: ‘রাত্রির আত্মায় যাবো ফিরে/ আমরা যুগলপাপী/ আজিকার যাত্রাশুরু হতে।’ নজরুল মনে করতেন মাটির মমতা রসে সিক্ত দেহমনের মানুষের হাতে এই ধরণীর তরণীর হাল থাকবে; দেবতাকে ডিঙিয়ে একদিন জাগবে সাধারণ ব্রাত্যজন। আবুবকর সিদ্দিকও সেই সাধারণ মানুষের বিজয় দেখেছেন অন্তরচোখে: ‘চূড়ান্ত পীড়নের দিনে—ঘূর্ণ খাওয়া বেতো মানবসম্প্রদায় সংগঠিত বাঁশঝাড়ের মতো ফিরে দাঁড়ায়।’
মানুষ নাকি বৃদ্ধকালে অনেকটা শিশুর মতো হয়ে যায়। শৈশবের স্মৃতির ঘ্রাণে উচাটন হয়ে ওঠে হৃদয় মন। শৈশব-কৈশোরের; মা-বাবা, দাদা-দাদি, খেলার সাথী, গৃহের উঠোন, মাঠঘাট নদী-বন-সবার সাথে সবকিছুর সাথে পুরাতন খেলায় মেতে উঠতে চায় মন। আর যদি বর্তমান জীবনযাত্রা দুঃসহ ঠেকে, তবে তো নস্টালজিয়াই হয়ে ওঠে সারাক্ষণের ভাবনা ও ভালো লাগার বিষয়। কবি আবুবকর সিদ্দিকের শেষের দিকের কবিতায় তাঁর জন্মভূমি দক্ষিণবঙ্গের গ্রামীণ পরিবেশ নদীনালা-সুন্দরবন এবং সেসময়ের আপনজনদের প্রতি স্মৃতিকাতরতা ও ভালোবাসা প্রবল হয়ে উঠেছে। এটা একদিকে নাড়ির টান, অন্যদিকে জীবনের হিসাব মেলাতে গিয়ে উঠে আসা হতাশার পরিচয়বাহী। তিনি সারাটাজীবন শহরে কাটিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু শহর তাঁকে দিতে পারেনি তাঁর চাওয়ার ধন। তিনি ততটা বিকশিত হয়ে উঠতে পারেননি প্রত্যাশিত ও প্রতিশ্রুত লক্ষ্য অর্জনের ফুল-ফসলে। অদৃশ্য ফাঁসঘেরা শহর তার কাছে এখন মনে হয়: ‘স্বাধীনচেতা বিপ্লবী, উদ্দাম প্রতিভাবান কবি ও উৎসর্গত প্রেমিকের বন্দিশালা’। এই অবস্থায় তাঁর অবারিত জন্মস্থানের ও বাল্য-কৈশোরের মুক্ত জীবন ফ্লাশব্যাক হয়ে ফিরে আসে তাঁর বেদনাহত স্মৃতিপটে:
‘তবু কেন কুহকেরা ভাজিয়ে যায় আলতো ছোঁয়া দিয়ে?
আষাঢ়ের ঢলে টইটম্বুর নদী দড়াটানা,
আর অই দেখো তীরে দাঁড়িয়ে কিশোর আমি
নদী আর আকাশের ধূসর সংগম দেখছি।’
(পাশবিক বৃষ্টিপাত/ আমার যত রক্তফোঁটা।)
কবি হওয়ার এবং কবিতা লেখার অহংকারে উচ্চশির তিনি: ‘কবির কাছে যাও হে পাঠক/ কোনো রাষ্ট্রকে সে শুল্ক দ্যায় না।’ কিন্তু সেই চির উঁচুশির কবিমানুষটি মোমের মতো গলে যান নারীর প্রেমে—তার রমণীর সংসর্গে। তাই তাঁর অগ্নিবাণী-উচ্চারণে অভ্যস্ত মুখে স্ফুরিত প্রেমের শান্তিকামী নির্জন সংলাপ:
‘ভালোবাসা বড় ভীরু কচি নেবুপাতা
চিরদিন মফঃস্বলে থাকে। …
তোমার নিশ্বাস লেগে কেঁপে যায় হাত আর ঠিক
তখন মাঠের মধ্যে অঝোরে নিঃশব্দ বৃষ্টি হয়ে যেতে থাকে
শিল্প চায় স্থিরতা, শিল্প চায় বিশুদ্ধ সম্পাত।’
(নেবুপাতা/ আমার সকল রসের ধারা)
দেশপ্রেম ও রমণীপ্রেম মিশে আছে আবুবকর সিদ্দিকের কবিসত্তায়, সেই সাথে তাঁর কাব্যভাবনার পরতে পরতে। যাবতীয় লোকনিন্দা, সামাজিক অপবাদ আর ভাবি বিরহের যন্ত্রণাকে তুচ্ছজ্ঞান করে তিনি প্রেয়সী নারীর নিবিড় সান্নিধ্যে থাকতে চান। বিচ্ছিন্নতার সব আশঙ্কাকে বৃদ্ধাঙুল দেখিয়ে প্রেয়সী অস্তিত্বের উঠোনের পাশে প্রেমের পড়শি হয়ে থাকতে চান। এটা তাঁর ভালোবাসার জেদ, বয়সের কাছে হার না মানা যৌবনের দাবি এবং সংবেদনশীল হৃদয়ের এক অদ্ভুত পিপাসা।
‘তুমি নিশ্চিত চলে যাবে না-ফেরা প্রবাসে
সুমেরু অথবা কুমেরু কোন
আদি অতিপ্রাকৃতের অন্তরালে
তবু জেনেশুনে আমি প্রতিদিন তোমার পথ চাই
প্রতিদিন ক্রমাগত আমি তোমার কাছেভিতে
আসি বসি বসত করি।’
(চলে যাচ্ছো জলে পুড়ে যাই/ বিনিদ্র কালের ভেলা)
তিনি গণমানুষের পক্ষে অর্থাৎ সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ, সংখ্যালঘু উপজাতি, বর্গাচাষি আর যতসব অত্যাচারিত বঞ্চিতের পক্ষে তাঁর কবিতাকে শপথবদ্ধ ও অগ্নিশাণিত করেছেন। আবার এই বিপ্লব-এই প্রেম-এসবের মাঝে ধান্দাবাজি, বেঈমানী আর নষ্টামিকেও শনাক্ত করতে ভুল করেননি তিনি। একজন আধুনিক মানুষের সংশয়ী মন নিয়ে সবকিছু দেখতে চেয়েছেন বাজিয়ে। আর ঠিক তখনি দেখতে পেয়েছেন: ‘দিকে দিকে দুর্বৃত্ত বুদ্ধিজীবী’ ‘রঙচোরা কৃকলাশ’ ‘মানুষের প্রেমে যাই পশুতায় মুখ পচে যায়’। আজীবন প্রগতিশীলতার পক্ষ নিয়েছেন; শোষিত বঞ্চিত মানুষের উত্থান ও বিজয় কামনায় অগ্নিহরফে গান লিখেছেন। পুঁজিপতি, জোতদার, ধর্মব্যবসায়ী আর রাষ্ট্রযন্ত্রের অবিচেনায় ব্যথিত হয়েছেন; ব্যথিত হয়েছেন আরও বেশি যখন দেখেছেন:
‘এ দেশে আলুর দরে বিকিয়ে গেছে শুভবুদ্ধি
রাজনীতি ল্যাজকাটা শেয়াল
‘প্রগতি’ তথা, ‘প্রগ্রেসিভ’ শব্দটাকে নিয়ে
কন্ডোমের মতো ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হচ্ছে।’
(একজন লেখকের অহংকার/ কালো কালো মেহনতী পাখি)
শ্রেণীবৈষম্য জর্জরিত সমাজের অবিচার, অসাম্য, আর ভণ্ডামির বিরুদ্ধে তিনি তাঁর কবিপ্রতিভা আর কলমকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। নজরুল যেমন বলে গেছেন যে, যারা তেত্রিশ কোটি দেবতার মুখের গ্রাস কেড়ে খায় তাঁর লেখার তাদের সর্বনাশ লেখা হোক,—সেটাই তার একমত চাওয়া। কবি আবুবকর সিদ্দিকও সমাজের বৈষম্য, অনাচার, শোষণ-বঞ্চনা দেখে ব্যথাহত হয়েছেন; আরও বেদনাহত হয়েছেন কথিত ‘প্রগতিশীল ও বামপন্থী’দের প্রত্যাশিত ভূমিকার অনুপস্থিতি আর কপটাচার দেখে। তিনি এসব কিছুর বিরুদ্ধে তাঁর কবিতাকে কাজে লাগাতে চেয়েছেন মানুষের প্রতি ভালোবাসা অর দায়বদ্ধতায় সমর্পিত থেকে:
‘চটকা তন্দ্রা ভেঙে জেগে উঠি;
চিতার আঁচপোড়া চাঁড়ালে গলায় ডাক দিই।
কোথা হে শব্দের সমরসম্ভার!
ল্যাজের ডগায় দাঁড়িয়ে পড়ো; ওঠো।
আগ্রাসী জানালা ও আধিপতাবাদী পাঁজর
ভেদ করে চলে যাও শব্দসেনা গুর্খা রেজিমেন্টে।’
(শব্দসেনা/ কালো কালো মেহনতি পাখি)
একদিকে এ বঞ্চনাবোধ, এই বিফল মনোরথ-অবস্থা, অন্যদিকে প্রকৃতি ও প্রাকৃতজনের প্রতি অপরিসীম দরদ ও ভালোবাসা শহরবাসী সিদ্দিককে ইটপাথরের উঠোন হতে টেনে নিয়ে গেছে—কখনো তাঁর জন্মভূমি বাগেরহাটের বাহিরদিয়া-ফকিরহাট-যাত্রাপুর ছাড়িয়ে ‘সবুজ অন্ধকার’ ভাঙতে ভাঙতে পুত্রপৌপত্রাদি রক্তসূত্র ধরে ‘জন্মস্বর্গে; কখনো-বা ‘উত্তরবঙ্গীয় বৃষ্টি’-তে ভেজার লোভে আষাঢ়স্য পদ্মার তীরে, জয়পুরহাট হাইওয়ে ধরে গান আর দৃশ্যে মুগ্ধহৃদয় নিয়ে দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দিরের প্রত্নছায়ায়, কখনো-বা ‘কানসটট্টিপ’ এর বাস ধরে লুপ্ত গৌড় চূর্ণগৌড়ের ধুলিধূসরিত ঐতিহাসিক পথ আর পৌরাণিক দীঘির রানায়—যেখানে শোনা যায় দিগ্বিজয়ী বখতিয়ারের ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ আর চারশ বছর ধরে সমাধির মতো স্তব্ধ শান্তির অলৌকিক অনুবাদ। এভাবেই বাস্তবে-কল্পনায়, ধূলির ভূগোলে—ভালোবাসার আকাশে, বর্তমানের রাজপথে—ইতিহাসের প্রত্নগুলোতে, জন্মস্থলের সবুজ অরণ্যে—কর্মস্থানের গেরুয়া মাটিতে পরিভ্রমণকারী আবুবকর সিদ্দিকের কর্মভাগ্যে জুটেছে সাফল্য, জুটেছে স্বীকৃতি। জুটেছে প্রেম, জুটেছে ঘর-সংসার। আবার জুটেছে এসবের বিপরীত অনেক কিছুই। ফলে কখনো কখনো নিজ হৃদয়ের রক্তক্ষরণে কঁকিয়ে উঠেছে মন, বিষিয়ে উঠেছে অস্তিত্বের বাতাবরণ।
সেই দুর্বল সময়ে ডেকে ডেকে কাছে পাননি প্রত্যাশিতদেরও। তখন প্রেয়সীর অধর নয়, বন্ধুর মুখ নয়, কন্যার কপোল নয়, তা মন চেয়েছে নির্জনতার মুখে চুমু খেতে। ‘কসমিক বিচ্ছিন্নতা’র সাথে একাকার হয়েছে তাঁর নিশীথফেরারী একাকিত্ব। মন ভেঙে পড়তে চেয়েছে। সেই দুর্বল মুহূর্তে মনে হয়েছে পিতামাতা এবং পিতামহের কবরের পাশে শুতে চলে যাবেন, ‘একান্ত সন্তানের মত’। কিন্ত কবি তো অমৃতের পুত্র। প্রকৃত কবির পরাজয় নেই। আল মাহমুদ তো বলেই ফেলেছেন: ‘পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা।’ আবুবকর সিদ্দিকও তাঁর কবিক্ষমতা নিয়ে চির উন্নত শির থাকতে চেয়েছেন। কোনো রাষ্ট্রক্ষমতা বা গৌরবহীন লোভের কাছে বিকিয়ে দিতে চাননি কবিতা কিংবা কবিতা লেখার কলমকে। তাই শোকে দুঃখে ক্ষোভে সাময়িকভাবে নেতিয়ে পড়লেও পরক্ষণেই গা ঝাড়া দিয়ে বলে উঠেছেন: আমি আছি। হতাশা কাটিয়ে আবার পা রেখেছেন জীবনের পথে। আর তখন তাঁর মনে হয়েছে নবীন কবিদের সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের পিছু ফেলে হেঁটে যাবেন জীবন ও জগতের পথে। কবিতার কমপিটিশন ট্রাকে। কারণ তিনি দেখতে পেয়েছেন তিনি নেভেননি:
‘অমোঘ উটের মত খরশান মরু পাড়ি দেবো।
ঠোঁটে বাবলাকাঁটার রক্ত, পিঠে নিঃশেষিত জলকুঁজ
চোখে ঘূর্ণী—বালির জাঙাল ঢুঁড়ে চলে যাবো
অযুত নিযুত যোজন!
… … … … … … … … … …
আমি নিভি নাই-
এ ধর্ষণে গেরুয়া পথেঘাটে এঁদোকাদা খঞ্জ পায়ে
খাবি খেতে যেতে আমি নিভি নাই’
(আমি নিভি নাই/ আমার সকল রসের ধারা)