বাংলা নাটক ও সেলিম আল দীন

0
34

ড. হারুন রশীদ
নিরন্তর সৃষ্টিশীলতায় মুখর সেলিম আল দীন (১৯৪৯-২০০৮) বাংলা নাটকের নব্যধারার প্রবর্তক, বিশ্ব নাট্যমঞ্চের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বাঙালির ভালোবাসায় পরিপ্লুত পুষ্পিত এই নাট্যজনকে বলা হয় বাংলা নাটকের গৌড়জন। তাঁর নাটকই বাংলা থিয়েটারের বহুযুগের প্রতীক্ষার অবসান ঘটায়। বাংলার মাটিতে, বাংলার জলহাওয়ায় বাংলার প্রাণের ভাষাতেই জন্ম নেয়া তার নাটকগুলো বাংলা নাটকের সব উপাদানকে ছুঁয়ে যায় আধুনিকের মন নিয়ে। এ কারণেই রবীন্দ্রোত্তরকালের বাংলা নাটকের প্রধান পুরুষ ভাবা হয় তাঁকে।
পরিণত পর্বে মাত্র ২৫/২৬ বছরের সৃজনশীলতার মধ্যেই বিস্ময়কর তাঁর রচনার বৈচিত্র্য ও বিস্তার। কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাতহদাইতে শিকড় সন্ধান ও মহাকাব্যিক বিস্তার। তা পেরিয়ে তিনি চলে যান চাকা, যৈবতী কন্যার মন, বা হরগজ নাটকের বর্ণনাত্মক রীতির নতুন পরীক্ষায়। বনপাংশুল বা প্রাচ্য’র পুরান প্রতীকে। বর্ণনাত্মক রীতির আরও সফল প্রয়োগ ঘটান নিমজ্জন ও ধাবমান এ। কিন্তু সব সময় লক্ষ্য তার স্বদেশের উন্মোচন। নাটকের সীমানা ছাড়িয়ে শিল্পের সমগ্রে পৌঁছানো। প্রত্মপ্রতিমার সঙ্গে আধুনিক এপিক দৃষ্টির সংযোগ ঘটিয়ে তোলা। এ এক বিশাল আয়োজন। নান্দনিকতা এবং মহাকাব্যিকতার দিক থেকে বাংলা নাটকে এতো বড় সমারোহ খুব একটা দেখা যায়নি।
বংলা নাটককে তিনি ঔপনিবেশিকতার অবলেশ থেকে মুক্তি দেন। বাংলা নাট্যমঞ্চে অনুবাদনির্ভর নাট্যচর্চার যে রীতি গড়ে ওঠেছিল সেখানে তিনি প্রতিস্থাপন করেন বাংলা ভাষার মৌলিক নাটককে। পর্দা উঠবে, পর্দা নামবে কিংবা চরিত্রের নাম ধরে সংলাপ লেখার মতো নাটক তিনি লিখেননি। কবিতা, গল্প, নাটক, চিত্রকলা শিল্পের এই বিভাজন ভেঙ্গে তিনি বাংলা নাটকে এক মহাকাব্যিক আয়োজন নিয়ে উপস্থিত হন। এ নাটক শুধু চার দেয়ালের মধ্যে মঞ্চের পাদপ্রদীপের নিচে মঞ্চায়নের জন্য নয়। বর্ণনায়, ভঙ্গিতে, বিষয়বৈচিত্র্যে, আখ্যানধর্মিতায় তার নাটক হয়ে এক অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তার নাটকের ভাষা বাংলা। বাঙালির আচার আচরণ, দৈনন্দিন জীবনযাত্রা তার ঐতিহাসিক সংগ্রাম-সিদ্ধি, অর্থনীতিক উপায়- উপকরণ, উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থা, পুরান রূপকথা, সংস্কার বিশ্বাস অবিশ্বাস, কৃত্যাদি, প্রথা-উৎসব, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক রীতি, নৈতিকতা, উৎসব-ক্রীড়াদি ইত্যাদি বিষয়কেন্দ্রিক পরিবেশনযোগ্য রচনা বাংলা নাটক এবং একই সঙ্গে তা বাঙালিরও নাটক। এই বিষয় বৈচিত্র ও মৌলিকতাই সেলিম আল দীনের নাটকে লভ্য।
সমালোচকের মতে, ‘রেনেসাঁস কালে ইংরেজরা প্রথমত ল্যাটিন ভাষায়, রোমানদের জাতীয় বিষয় নিয়ে নাটক রচনা করতো। তখন তা ইংরেজি নাটক বলে স্বীকৃতি পায়নি। অতঃপর ল্যাটিন ভাষায়, ইংরেজদের জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিক নিয়ে নাটক রচনা করতে থাকে। কিন্তু তা জাত্যাভিমানী ইংরেজদের নিকট ইংরেজি নাটক পদবাচ্য হলোনা। অবশেষে ইংরেজি ভাষায়, ইংরেজ জাতির সামগ্রিক পরিচয়বাহী বিষয়াদি অবলম্বনে রচিত নাটক তাদের জাতির ইতিহাসে ইংরেজি নাটকের মর্যাদায় অভিষিক্ত হলো।
যে জীবন তিনি ধারণ করেছিলেন তা যুগস্রষ্টা শিল্পীর জন্য স্বল্পায়ুর কিন্তু যে জীবন তিনি যাপন করেন এবং ছুঁয়েছিলেন তার ব্যাপ্তি সীমাতীত। মর্তের তৃণবলি থেকে আকাশমণ্ডলের নক্ষত্ররাজির মধ্যবর্তী সকল বস্তু ও প্রাণির সঙ্গে মানবের সম্পর্ক নিরূপণে তিনি আমৃত্যু অনুসন্ধিৎসু স্রষ্টা। সেলিম আল দীনের রচনার নিত্য পাঠ নবতর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করায় তাঁর পাঠকদের। আত্ম আবিষ্কারের এক বিশাল সুযোগ রয়েছে সেখানে।
ইতিহাসের এই দৃষ্টান্ত সম্মুখে বিদ্যমান থাকা স্বত্ত্বেও জাতীয়তাবাদী বাঙালি একমাত্র দাস মনোবৃত্তির কারণেই যে ইউরোপীয় রীতির বা আঙ্গিকের নাটককে নিজস্ব বলে গ্রহণ করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’ নাটকের পরিসর ভেঙে সেলিম আল দীন সেখানে চিত্রকলা, নৃত্যকলা, অভিনয়কলা, সঙ্গীত এবং আখ্যান, উপাখ্যানের সমন্বয়ে-সংমিশ্রণে শেষাবধি নতুন এক নাট্য আঙ্গিক নিয়ে উপস্থিত হন। এই নাটককে বাংলা নাটক বলে গ্রহণ করতে আর কোনো দ্বিধা রইলো না।
ছোটবেলা থেকেই তার লেখক জীবন শুরু হলেও ১৯৬৮ সালে কবি আহসান হাবীব সম্পাদিত ‘দৈনিক পাকিস্তান’ (অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলা) পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে কালো মানুষদের নিয়ে প্রথম বাংলা প্রবন্ধ ‘নিগ্রো সাহিত্য’ প্রকাশিত হয়। তার প্রথম রেডিও নাটক ‘বিপরীত তমসায়’ ১৯৬৯ সালে এবং প্রথম টেলিভিশন নাটক আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘লিব্রিয়াম’ প্রচারিত হয় ১৯৭০ সালে। ‘বহুবচন’ কর্তৃক প্রযোজিত হয় তার প্রথম মঞ্চনাটক ‘সর্প বিষয়ক গল্প’ ১৯৭২ সালে। এরপর থেকে একের পর এক নতুন নতুন বিষয় ও আঙ্গিকে সৃষ্ট তার নাটক উচ্চারিত হয় বাংলা মঞ্চে, টেলিভিশনে। শুরু করেছিলেন বিদেশ অনুপ্রাণিত নিরীক্ষাকে ভর করে, কিন্তু খুব শীঘ্র তা বর্জন করে বাংলার মধ্যযুগীয় নাট্যরীতির সম্ভারে গড়ে তুললেন নিজর জগত। ভাঙা মানুষ, তারুণ্যের বিলীয়মান উপজাতি, লাঞ্ছিত নারী এই নিচুতলার মানুষেরই ভিড় লভ্য তার নাটকে।
পাশ্চাত্য শিল্পের সব বিভাজনকে বাঙালির সহস্র বছরের নন্দনতত্ত্বের আলোকে অস্বীকার করে এক নবতর শিল্পরীতি প্রবর্তন করেন তিনি। যার নাম দেন ‘দ্বৈতাদ্বৈতরীতি শিল্পতত্ত্ব’। বর্ণনাত্মক নাট্যরীতিতে লেখা তার নাটকগুলোতে নিচুতলার মানুষের সামাজিক নৃতাত্ত্বিক পটে তাদের বহুস্তরিক বাস্তবতাই উঠে আসে। জণ্ডিস ও বিবিধ বেলুন, মুনতাসির, শকুন্তলা, কিত্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল, হাতহদাই, যৈবতী কন্যার মন, চাকা, হরগজ, বনপাংশুল, প্রাচ্য, নিমজ্জন, ধাবমান, স্বর্ণবোয়াল ইত্যাদি মঞ্চসফল ও পাঠকনন্দিত নাটক রচনার মধ্য দিয়ে ক্রমাগত তিনি নিজেকে অতিক্রম করে যেতে থাকেন। তিনি অবশ্য তার সৃষ্ট শিল্পের কোনো নাম দিতে চাননি। তার ভাষায় ‘আমি চাই আমার শিল্পকর্মগুলো নাটকের অভিধা ভেঙ্গে অন্যসব শিল্পতীর্থগামী হয়ে উঠুক’ ।
আখ্যান বা বর্ণনাত্মক নাট্যরীতিতে লেখা উপন্যাসগুলোতে তিনি কাব্য, উপন্যাস, চিত্রকর্ম প্রভৃতি শিল্পধারাকে এক মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করেছেন। মধ্যযুগের বাংলা নাট্যরীতি নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বাংলাদেশে একমাত্র বাংলা নাট্যকোষেরও তিনি প্রণেতা। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণকেন্দ্রিক এথনিক থিযেটারেরও তিনি উদ্ভাবনকারী। তার নাটক ‘চাকা’ র চলচ্চিত্ররূপ আন্তর্জাতিকভাবে একাধিক পুরস্কার পেয়েছে। তার রচিত কথানাট্য ‘হরগজ’ সুইডিশ ভাষায় অনুদিত এবং ভারতের নাট্যদল রঙ্গকর্মী কর্তৃক হিন্দি ভাষায় মঞ্চস্থ হয়েছে।
তাঁর সৃষ্টিশীলতার কিরণচ্ছটা ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যের ধ্রুপদী ধারায় শ্রমজীবী মানুষ এবং বাংলার আবহমানকালের সংস্কৃতিকে এক মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি দানে সার্থক হন তিনি। পেশা হিসেবে বেছে নেন অধ্যাপনাকে। এরপর থেকেই তার কর্মক্ষেত্র বিস্তৃততর হতে থাকে। একদিকে সৃজনশীলতার ভুবন আলোকিত করে রাখেন তার নতুন নতুন ভিন্নমাত্রিক রচনা সম্ভার দিয়ে।
অন্যদিকে শিল্পের একাডেমিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির জন্য কাজ করে যান সমান্তরালে। ১৯৮৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তার উদ্যোগেই খোলা হয় নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ। শিক্ষকতার পাশাপাশি এ দেশের নাট্যশিল্পকে বিশ্ব নাট্যধারার সঙ্গে সমপঙক্তিতে সমাসীন করার লক্ষ্যে ১৯৮১-৮২ সালে দেশব্যাপী গড়ে তোলেন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার। এর আগেই অবশ্য তার আজীবনের শিল্পসঙ্গী নাট্যনির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। রক্তের আঙুরলতা, অশ্রুত গান্ধার, গ্রন্থিকগণ কহে, ভাঙনের শব্দ শুনি, অনৃত রাত্রি, ছায়াশিকারী, রঙের মানুষ, নকশীপাড়ের মানুষেরা, প্রত্মনারী, হীরাফুল প্রভৃতি অসংখ্য জনপ্রিয়টিভি নাটকের রচয়িতা সেলিম আল দীন।
পাঠকের ভালোবাসায় পরিপ্লুত সেলিম আল দীন পেয়েছেন নানাবিধ পুরস্কার। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), ঋষিজ কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা (১৯৮৫), কথক সাহিত্য পুরস্কার (১৩৯০ বঙ্গাব্দ), একুশে পদক (২০০৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (কিত্তনখোলা , কাহিনী ও সংলাপ), অন্য থিয়েটার, কলকাতা কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা নান্দিকার পুরস্কার, আকাদেমি মঞ্চ কলকাতা, (১৯৯৪), শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন নাট্যকার (১৯৯৪), খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার (২০০১), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (একাত্তরের যীশু, শ্রেষ্ঠ সংলাপ) ১৯৯৪ মুনীর চৌধুরী সম্মাননা (২০০৫), কথাসাহিত্য পুরস্কার (২০০২), সৈয়দ বদরুদ্দীন হোসাইন স্মারক সম্মাননা (২০১৮, মরণোত্তর) এবং স্বাধীনতা পুরস্কার (২০২৩)।
আজ ১৪ জানুয়ারি এই যুগস্রষ্টা শিল্পীর মহাপ্রয়াণ দিবস। গবেষকদের বিবেচনায় মহান স্বাধীনতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন। বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির মহার্ঘতা তার রচনায় নতুন মাত্রা লাভের ফলে আমাদের শিল্প-সাহিত্য চর্চার নব দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। যে জীবন তিনি ধারণ করেছিলেন তা যুগস্রষ্টা শিল্পীর জন্য স্বল্পায়ুর কিন্তু যে জীবন তিনি যাপন করেন এবং ছুঁয়েছিলেন তার ব্যাপ্তি সীমাতীত। মর্তের তৃণবলি থেকে আকাশমণ্ডলের নক্ষত্ররাজির মধ্যবর্তী সকল বস্তু ও প্রাণির সঙ্গে মানবের সম্পর্ক নিরূপণে তিনি আমৃত্যু অনুসন্ধিৎসু স্রষ্টা। সেলিম আল দীনের রচনার নিত্য পাঠ নবতর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করায় তাঁর পাঠকদের। আত্ম আবিষ্কারের এক বিশাল সুযোগ রয়েছে সেখানে।