কূপমণ্ডুকতায় আচ্ছন্ন হওয়া মানে পিছিয়ে যাওয়া

0
42

শাহানা হুদা রঞ্জনা
‘শরীফ’ থেকে ‘শরীফা’ হওয়ার গল্পের পাতা ছিঁড়ে ফেলার ঘটনার মাধ্যমে সবচেয়ে দুঃখজনক যে বিষয়টি উঠে এলো তা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যুটি নিয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়া এবং ব্যাখ্যা। হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার সম্পর্কে ভুল জানা, অর্ধেক তথ্য জানা, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার কীভাবে শহুরে শিক্ষিত মানুষের মনে গেড়ে বসে আছে এটাই প্রমাণিত হলো। সেইসাথে এটাও প্রমাণিত হয়েছে অনেক মানুষ জেনেশুনেও সত্য এড়িয়ে যেতে চাইছেন। হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি শোনার পরে যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছেন অনেকে, যেন মনেহচ্ছে অশ্লীল কোন জনগোষ্ঠীর কথা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
কোনো বিষয় নিয়ে ব্যক্তি কী প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছেন বা কি ব্যাখ্যা দিচ্ছেন সেটা সেই ব্যক্তির জ্ঞান, চরিত্রের বিশুদ্ধতা এবং চিন্তাভাবনার সুস্থতা প্রমাণ করে। শরীফ থেকে শরীফার গল্প নিয়ে ধর্মব্যবসায়ীদের কথা বাদ দিলেও উচ্চশিক্ষিত অনেকের প্রতিক্রিয়া এবং ব্যাখ্যাও বিভ্রান্তিপূর্ণ। বলতে বাধ্য হচ্ছি এই অপব্যাখ্যা ও বিভ্রান্তি ওইসব পেশাজীবীদের ইনটেলেকচুয়াল ক্যাপাসিটি ও ইনটিগ্রিটির অভাবকে তুলে ধরছে, এরচেয়েও ঢের বেশি ক্ষতি করছে সমাজের চিন্তাভাবনাকে। এই সমাজের একটা বড় অংশ “বই ছিঁড়ে ফেলো, বই ছিঁড়ে ফেলো” শ্লোগান তুলছেন এবং সেইমতো কাজ করাতে সরকারকে বাধ্য করতে চাইছেন।
অনেকে মনে করছেন হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুটি কেন এতটা গুরুত্বপূর্ণ যে এটা নিয়ে এত সময় নষ্ট করতে হবে? ইস্যুটা কিন্তু সময় নষ্ট নয় বা অযথা তর্ক-বিতর্ক নয়। এ হচ্ছে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ একদল প্রান্তিক মানুষকে বোঝা ও সম্মান করার বিষয়, তাদের অধিকার রক্ষার বিষয়। এই মানুষগুলো সম্পর্কে যে ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, তাতে সমাজে এদের অবস্থান আরো প্রান্তিক ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে।
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির প্রতি কোনো কোনো গোষ্ঠীর ভয়, ঘৃণা ও অবজ্ঞা প্রকাশের বিরুদ্ধে আবার কলম ধরতে হলো। আরো অদ্ভুত ব্যাপার যে দুটি “পাঁচ তারকা বিশ্ববিদ্যালয়ে”র কিছু শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি এই ভুল ধারণার সাথে জড়িত। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা ব্যবস্থা, ঝকঝকে ক্যাম্পাস, ইংরেজি ভাষায় পাঠদান, একাডেমিক ক্যারিয়ার, আধুনিক পড়াশোনা জানা হলেই যে একজন মানুষ যথার্থ শিক্ষিত, কনসেপচুয়ালি ঠিক ও আধুনিক মানুষ হবেন, তা বলা যায় না।
এর প্রমাণ সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের তরুণ শিক্ষক মাহতাবের ‘শরীফ’ থেকে ‘শরীফা’ হওয়ার গল্পের পাতা ছিঁড়ে ফেলার ঘটনা এবং গত নভেম্বরে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে হোচিমিনকে ট্রান্সজেন্ডার নারী পরিচয়ের কারণে আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে বাধা দেয়ার ঘটনা। সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ট্রান্সজেন্ডারের গল্প ঢুকিয়ে শিক্ষার্থীদের মগজধোলাই করা হচ্ছে – এই মর্মে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ মাহতাব যা বলছেন, সেই কথা এখন সবারই জানা হয়ে গেছে। একদল ছাত্রছাত্রী প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে ওই শিক্ষকের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করেছে, সামাজিক মাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
‘শরীফ থেকে শরীফার’ গল্পের প্রধান আপত্তির জায়গাটা হল শরীফা যখন বলে তার লিঙ্গান্তরের কথা: “ছোটবেলায় সবাই আমাকে ছেলে বলত। কিন্তু আমি নিজে একসময়ে বুঝলাম, আমার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে। মেয়েদের সঙ্গে খেলতেই আমার বেশি ইচ্ছে করত। কিন্তু মেয়েরা আমাকে খেলায় নিতে চাইত না। ছেলেদের সঙ্গে খেলতে গেলেও তারা আমার কথাবার্তা, চালচলন নিয়ে হাসাহাসি করত। স্কুলের সবাই, পাড়া-পড়শি এমনকি বাড়ির লোকজনও আমাকে ভীষণ অবহেলা করত। আমি কেন এ রকম একথা ভেবে আমার নিজেরও খুব কষ্ট হতো, নিজেকে ভীষণ একা লাগত।”
এই বিষয়টি নিয়ে যারা আপত্তি করছেন তাদের অনেকেই মনে করেন শরীফের ছোটবেলায় ছেলে থাকা এবং একসময়ে সে বুঝতে পারে যে সে মেয়ে, এটা শরীফার খেয়াল খুশি মতোই হয়েছে। এইসব সমালোচনাকারীদের মূল আপত্তিও এখানেই। তারা মনে করেন যে কেউ তার ইচ্ছা মতো ছেলে থেকে মেয়ে হতে চাইছে। সমালোচনাকারীরা যে বিষয়টি জানেন না বা জেনে বুঝেও এড়িয়ে যেতে চাইছেন, তা হলো মানুষের বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তন প্রক্রিয়া। যাকে মানুষের ’দ্বিতীয় যৌন চরিত্রের প্রকাশ’ বা ’সেকেন্ডারি সেক্সুয়াল এক্সপ্রেশন’ বলে।
হয়তো শরীফা শিশুকালে একটি পুরুষাঙ্গ নিয়েই জন্মগ্রহণ করেছে। তাই তাকে ছেলে শিশু মনে করা হতো এবং সেও তাই ভাবতো, তাই তার নাম ছিল শরীফ। বয়ঃসন্ধিকালে দ্বিতীয় যৌন চরিত্রের প্রকাশের সময় যে হরমোনের বিকাশ ঘটে তার ক্ষেত্রে সেটি ছিল নারী হরমোনের আধিক্য। তাই হয়তো তার নারীর মতো বৃদ্ধি শুরু হয়, দাড়ি গোঁফ গজায় না এবং তার কণ্ঠস্বর নারীদের মত হয়ে যায়। তখন তার আবেগ ও আচরণ নারীদের মত হয়ে যায় বলে সে মনে করে যে, সে আসলে নারী তাই তার নাম হয় শরীফা।
সে হয়তো তার পুরুষাঙ্গটি পোশাকের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে পেরেছিল কিন্তু তার দাড়ি-গোফ না গজানো এবং তার কণ্ঠস্বর লুকিয়ে সমাজে পুরুষ হিসাবে বাস করা সম্ভব হচ্ছিল না। শুধু ইচ্ছা করছে বলেই শরীফা ছেলে থেকে মেয়ে হতে চায় নাই, তার বয়ঃসন্ধিকালের দ্বিতীয় যৌন চরিত্রের প্রকাশ তাকে বাধ্য করেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা তাঁর এক লেখায় এই ট্রান্সজেন্ডার শব্দটিই ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, “ট্রান্সজেন্ডার একটি পশ্চিমা আমব্রেলা টার্ম, যার বাংলা রূপান্তরিত জনগোষ্ঠী। সহজ করে বললে আপনি যদি আপনার জন্মগত বৈশিষ্ট্য বা আইডেন্টিটির বিপরীতে অন্য কোনো ধরনের আইডেন্টিটিকে ধারণ করতে চান তবে আপনি ট্রান্স আইডেন্টিটির মধ্যে নিজেকে শনাক্ত করতে পারেন। ট্রান্সজেন্ডার-এর মধ্যে দুটি ভাগ আছে। ট্রান্স-ম্যান ও ট্রান্স- ওমেন। এক্ষেত্রে ধরুন, আপনি এক্স এক্স ক্রোমোজোম নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং আপনি জৈবিকভাবে একজন নারী। কিন্তু আপনি আপনার পিউবার্টি চলাকালীন (বয়ঃসন্ধিকাল) আবিষ্কার করলেন আপনি একজন পুরুষ।
এক্ষেত্রে হতে পারে বয়ঃসন্ধিকালে আপনার মাসিক হওয়ার কথা, কিন্তু সেটি হরমোনাল ব্যালেন্সের কোনো কারণে হয়নি। অথবা আপনি সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত নারীত্বকে গ্রহণে অনাগ্রহী। এমনকি আপনার শারীরিক পরিবর্তন আপনার মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্যে প্রতিফলিত হতে পারে। আপনি নিজেকে একজন পুরুষ হিসেবে পরিচিতি দানে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
অন্যদিকে ট্রান্স ওমেন, শারীরিকভাবে পুরুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেও তার যৌনাঙ্গ ‘পুরুষালিভাবে’ ক্রিয়াশীল নাও হতে পারে। যৌনাঙ্গের গঠন কাঠামোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি নাও হতে পারে। আবার যৌনাঙ্গ পুরোপুরি স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার পরও পুরুষ হিসেবে নিজ শরীর অথবা মনকে নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। এরকম অবস্থায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত নারীর শরীরী অবয়বে আত্মপ্রকাশের সচেষ্ট হয়ে ট্রান্স-ওমেন হিসেবে তিনি আবির্ভূত হন।
বলা বাহুল্য, এই রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি শারীরিক এবং মানসিক। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা হরমোন গ্রহণের মধ্য দিয়ে শারীরিক ট্রান্সফরমেশনের মধ্য দিয়ে যান অথবা সেক্সচুয়াল রি-অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি করেন। উল্লেখ্য, এই সেক্সচুয়াল রি-অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি একই সঙ্গে সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। পাশাপাশি তাদের হরমোনাল থেরাপির প্রক্রিয়াটিও সময়সাপেক্ষ ও জটিল। হিজড়া লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর মধ্যে রূপান্তরকামীর সংখ্যাও কম নয়। এই প্রক্রিয়াতে যুক্ত রয়েছে কিছু নির্দিষ্ট চিকিৎসক।
এই চিকিৎসা গ্রহণ প্রক্রিয়াটি ভীষণভাবে গোপনীয়। এমনকি যারা এই চিকিৎসা প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত তাদের প্রায়শই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, মিডিয়াতে ও আইনের চোখে অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হয়। অথচ এই চিকিৎসা গ্রহণ প্রক্রিয়াটি লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর জন্য তথা হিজড়া জনগোষ্ঠীর ও ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য ভীষণ স্বাভাবিক একটি বিষয়। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইরানে রূপান্তরকামী জনগোষ্ঠীর লিঙ্গ পরিবর্তনের বিষয়টি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত এবং রাষ্ট্রীয় খরচে তা বহন করা হয়।।
সমাজের অনেক মানুষ এই সহজ বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেন না বা জানেন না। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েদের অনেকধরনের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হয়, যা বড়রা বুঝতে চান না এবং বুঝলেও পাত্তা দিতে চান না। বয়ঃসন্ধিকালের মানুষের জীবনে এই যে পরিবর্তন, যাকে মানুষের দ্বিতীয় যৌন চরিত্রের প্রকাশ বলে মনে করা হয়, সেটা সম্পর্কে নেতিবাচক মতামত প্রকাশ করেন। এমনকি তাদের নিজেদের জীবনেও যে এটা ঘটেছে সেটাও ভুলে গেছেন।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ মাহতাবকে যারা সাপোর্ট করে সোচ্চার হয়েছেন, তারাতো এককাঠি বেশি। তারা ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়াদের ‘সমকামী’ হিসেবে দেখছেন। হিজড়ার সাথে সমকামিতার কী সম্পর্ক? ট্রান্সজেন্ডার কি সমকামী? এই উত্তরটা খুব সাধারণ কমনসেন্স থেকে পাওয়া যায়।’ সমকামিতার সহজ উত্তর হচ্ছে সম-লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ। এখন আপনি যদি ট্রান্স ম্যান অথবা ট্রান্স ওমেন-এর দিকে তাকান, খেয়াল করবেন, অধিকাংশ সময়ই সে নিজেকে যদি নারীতে রূপান্তরিত করে, সে সেক্সচুয়াল রি-অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি করায়, একটি কৃত্রিম ভ্যাজাইনা ইমপ্ল্যান্টেশন করে এবং যৌন সঙ্গমের জন্য একজন পুরুষ সঙ্গীকে বেছে নেয়।
অন্যদিকে সে যদি ট্রান্স ম্যান হয়, সে তার পুরুষ যৌনাঙ্গ অর্থাৎ শিশ্ন এমাসকুলেশন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রূপান্তরিত করে। তার যৌনতার আকর্ষণ হয় নারীর প্রতি। তাহলে প্রশ্ন করা যেতেই পারে যে কীভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় এদের সমকামী বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে? কেবল শারীরিক বা জৈবিক বাস্তবতাই কি একমাত্র সত্য?” (সূত্র:ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ইসলাম ধর্মে হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ে কোনো বিরোধিতা নাই। অনেকে বলছেন ট্রান্সজেন্ডার বিষয়টা ইসলামে নাই, তাই এসব কথাকে গ্রহণ করা অবশ্যই হারাম। যারা ‘শরীফ ও শরীফা’র গল্পে ইসলামকে টেনে আনছেন, তারা হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বা না বুঝে এসব করছেন। তারা চাইছেন এসব মনগড়া তথ্য পড়ে মানুষ যেন ভুল বুঝেন ও ক্ষেপে ওঠেন। এরপর এর উপর ভিত্তি করেই চমৎকার এই করিকুলামটি তুলে নেবে সরকার।
ইসলাম ট্রান্সজেন্ডার এবং জেন্ডার বিষয়ে কি বলে? ক্লাসিকাল ইসলামিক ল বা রুলস চার ধরনের জেন্ডার বা লিঙ্গবৈশিষ্ট্যকে সংজ্ঞায়িত করে। পুরুষ, নারী, ডিএসডি বা খুনসা এবং মুখাননাত। খুনসা বা ট্রান্সজেন্ডারকে আবার ইসলাম দুইটি সাব ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছে। ওয়াদিহ বা খুনসা ঘায়ের এবং খুনসা মুসকিল। যখন বাহ্যিক জননাঙ্গ দিয়ে সেক্স ডিফাইন করা যাচ্ছে না তখন ইসলামে তাদের “মেলনেস” বা “ফিমেলনেস” চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে ডিফাইন করার কথা বলা হয়েছে।
আর মুখাননাত হল জেন্ডার ডিসফোরিয়া। তার মানে এতক্ষণ যা বললাম তার সবই ইসলামে অলরেডি গৃহীত এবং প্রপারলি ডিফাইন্ড। এমনকি ফিকহ শাস্ত্রে ট্রান্সজেন্ডারদের সম্পত্তির অধিকার, বিবাহের নিয়ম, নামাজ পড়ার নিয়ম, পরদা সম্পর্কেও বিস্তারিত বলা আছে। তাই যারা বলছেন ট্রান্সজেন্ডার বিষয়টি ইসলামে স্বীকৃত নয় তারা কিছু না জেনে বুঝেই বলছেন। (সূত্র: – ডাঃ তানজিনা হোসেন, হরমোন বিশেষজ্ঞ) সেক্সুয়াল আইডেন্টিটি সোশ্যাল ও লিগ্যাল স্ট্যাটাস। সেটাকে ইচ্ছামত পরিবর্তন করা যায় না। ‘শরীফ’ থেকে ‘শরীফা’ হওয়ার গল্প নিয়ে বিতর্কের মূল কারণ হল যৌন (সেক্স) ও লিঙ্গ (জেন্ডার) এই দুটোকে পৃথকভাবে বুঝতে না পারা। আমাদের মতো দেশে সনাতনী চিন্তার মানুষের অভাব নাই। এরা মানুষকে শুধু বস্তুগত বা যৌন ভিত্তিক বা যৌনাঙ্গ নির্ভর দৃষ্টিতে দেখতে পান। তারা মানুষের জেন্ডার একজিসট্যান্স বুঝতে পারেন না।
মানুষের লিঙ্গভিত্তিক অবস্থিতি বা জেন্ডার একজিসট্যান্স থাকে তার মগজে, কখনও কখনও সেটা তাদের দেহে যে যৌনাঙ্গ আছে তার সাথে পরস্পরবিরোধী বা কন্ট্রাডিকটরিও হতে পারে। তেমন মানুষেরা যারা বায়োলজিকালি ছেলে বা মেয়ে হয়েও নিজেকে বিপরীত লিঙ্গের মানুষ মনে করেন, তাদের কেউ চিকিৎসার মাধ্যম লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পারেন। এরজন্য মেডিক্যাল ও লিগ্যাল সার্টিফিকেশন লাগবে। শরীফার গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রের ব্যক্তিটি পরিষ্কারভাবে ট্র্যান্সজেন্ডার যারা বয়ঃসন্ধিকালে প্রাকৃতিকভাবেই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়।
কাজেই শরীফার গল্পের শরীফ বা শরীফার পরিচয় নিয়ে বিতর্ক করার কোনো মানে হয় না। ট্রান্সজেন্ডার হোক আর হিজড়াই হোক সব মানুষকে সম্মান করতে হবে, অধিকার দিতে হবে এটাই শিক্ষা হওয়া উচিৎ। সপ্তম শ্রেণির বইতে নয়, গোড়ায় গলদ ওই দর্শনের শিক্ষক ও তার অনুসারীদের। পাঠ্যসূচিতে এরকম একটা জরুরি বিষয়সহ আরো অনেক প্রাসঙ্গিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে আমাদের সন্তানদের কাছে এমন অনেক ইস্যু স্পষ্ট করা হচ্ছে, যেগুলো নিয়ে পরিবার আলোচনা করতে কুণ্ঠাবোধ করে ও সামাজিক ট্যাবু রয়েছে।
বইতে যে খুব সহজ ভাষায় এসব প্রসঙ্গে কথা বলা হয়েছে এর জন্য সাধুবাদ জানানো উচিত। কোনো ভুল ত্রুটি থাকলে সেই কথা যথাযথ জায়গায় বলা উচিৎ। একজন শিক্ষকের পক্ষেতো সেটা বলা আরও বেশি দরকার। আমাদের সমাজে শিশু ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়াদের সাধারণত বয়ঃসন্ধির আগে যৌন পরিচয় লুকিয়ে ছেলে বা মেয়ে হিসাবে পরিবারে রাখা হয়। বয়ঃসন্ধির পরে যেহেতু বাহ্যিক দৈহিক ও কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন লুকিয়ে রাখা যায় না তখনই তার ট্র্যান্সজেন্ডার চরিত্র প্রকাশ পায়। এই লুকিয়ে রাখা ফলে অনেক সময় শিশুটি নিজেকে যা ভাবতো তার সাথে কনট্রাডিক্টরি হতে পারে। গল্পটিতে সেটিই বলা হয়েছে।
এরা স্বীকার করতে চান না যে, সেক্স ও জেন্ডার এক জিনিস নয়। সেক্স জিনিসটা মেডিকেলি বা বায়োলজিকালি ডিফাইন করা সম্ভব, জেন্ডার নয়। জেন্ডার তৈরি করে সমাজ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা। এখানে মনোজগতেরও একটা গভীর যোগাযোগ আছে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকার পরও কেউ কেউ ‘জেন্ডার ডিসফোরিয়া’তে ভুগতে পারে।
ট্রান্সজেন্ডারদের চিকিৎসা নিয়ে সব দেশেই বিতর্ক আছে, মুসলিম দেশগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই বেশি। তবে অন্যরা আমাদের মত ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বসে নাই। তারা এ নিয়ে ধর্মবেত্তা ও ধর্মীয় নেতাদের সাথে বসে আইন কানুন তৈরি করছে। অন্ধকারের মধ্যে বসে না থেকে আমাদেরও বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে হবে, আইন করতে হবে।
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।