পহেলা ফাল্গুন: আজ অনুভবের দিন

0
35

সুন্দর সাহা
‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক, আজ বসন্ত।’ আবহমান বাংলার প্রকৃতিতে আজ ফাগুনের ছোঁয়া, বকুল বৃক্ষের পাতার ফাঁক দিয়ে যেন উঁকি দিচ্ছে পূবের সূর্য। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়- ‘আজি দখিন-দুয়ার খোলা, এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো…।’ মাঘের হিমের বুকের তলে আধফোটা হয়ে আছে ফাগুনের ফুল। শিরশিরে হিম হাওয়া ক্রমশই হয়ে উঠছে ফুরফুরে ওম। ‘আজ পহেলা ফাল্গুন।’ ‘ভালোবাসা দিবসও আজ। ঋতুচক্রের নিয়মে এসেছে ঋতুরাজ বসন্ত। নিষ্পত্র শাখাগুলোতে নবীন কিশলয়। অজস্র পলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম আভায় বনে লাগছে আগুন। তার আঁচ লাগছে নবীন-প্রবীণ মনেও। ভোরের বাতাসে জেগে উঠছে নতুন প্রাণ। আমাদের বসন্তের ফুলের যেন অভাব নেই। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, কাঁঠালচাঁপা, কাঠগোলাপ, নাগেশ্বর, রুদ্রপলাশ, মহুয়া, রক্তকাঞ্চন, দেবদারু, স্বর্ণশিমুল। গাছে গাছে কত কত ফুল। এ বসন্তে থোকায় থোকায় ফোটে নজরুলের প্রিয় ফুল দোলনচাঁপা। ফোটে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ফুল অশোক, পলাশ, শিমুল। এমনই সময়ে আমের মুকুলের ঘ্রাণে পাগল হয়েছিল কবিগুরুর মন। গাছে গাছে রঙিন ফুল জানান দিচ্ছে, বসন্ত এসে গেছে। বসন্ত বাতাসে মনে জাগে ভালোবাসাও। এবার বসন্তবরণ ও ভালোবাসা দিবস পালন করা হচ্ছে একই দিনে। তাই যেন রাঙা পলাশের ডালে পাশাপাশি বসে ভাব-ভালোবাসায় মগ্ন একজোড়া কাঠশালিক। প্রকৃতিতে এখনো শীতের রেশ। থেকে থেকে বইছে দমকা বাতাস। তবে কুহেলিকাভেদী নরম রোদ, গাছে গাছে নতুন পাতা, তাতে রোদের ঝিকিমিকি, কোকিলের কুহু ডাক। মধুমাস চৈত্রের ঋতু এ বসন্ত। মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী বলেছেন, ‘মধুমাসে মলয় মারুত মন্দ মন্দ। মালতীর মধুকর পিয়ে মকরন্দ।’ অর্থাৎ মধুমাসে মৃদুমন্দ বাতাস বয়, মৌমাছিরা ফুলের মধু খায়। প্রকৃতির মতো মানুষের মনেও এ সময় নতুন আনন্দ ভাব জাগে। এ ভাব প্রণয়ের। বৈষ্ণব পদাবলিতে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাসের মতো কবিরা প্রেমরসের কবিতা লিখেছেন। শীতঝরা হাজার প্রাণে কচিকুশি হেসে উঠেছে পুনর্বার। মাঘের সাঁঝও গেয়ে গেছে বিদায়ের গান। বসন্ত এসে গেছে! এই নবাগত বসন্তকে বরণ করতেই মুখিয়ে আছে ঝিঙুরের ঝাঁক। মাঘের শীতকে বিদায় জানিয়ে বসন্তের আগদনে ফাগুনের ঝিরিঝিরি হাওয়ার সাথে কোকিলের কুহুতানে যেন মন ভরে যায়। চোখ জুড়িয়ে যায় বাগানের রক্তিম পলাশ, অশোক, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া, কাঞ্চন পারিজাত, মাধবী আর গাঁদার ছোট ছোট ফুলের বর্ণিল রূপে। মনের বাড়তি কষ্ট যেন আজ ফাগুনের আগুনে ছাঁই হয়ে গেছে। সবাই সেজেছে বাসন্তী সাজে। কোথাও কোথাও কোকিলের কুহু ডাক, কোথাও বা গাছের শাখায় সবুজ কুঁড়ি, রঙিন ফুলের নাচ। ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে। তাই তো গানের সুরে, নাচের ছন্দে, রঙির পোশাকের বর্ণচ্ছটায় প্রকৃতই রাজসিক আড়ম্বরে ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করে নেবে নানা বয়সের মানুষ। বসন্ত ভালোবাসার ঋতু। অনুভব আর আবেগের ঋতু। ভালোবাসার মানুষকে আরো কাছে পাওয়ার সময় এ বসন্ত। বসন্ত আসে তরুণের পোশাকে, মননে, সংগীতে। বাঁধনহারা মন এ সময় গেয়ে ওঠে, ‘মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে।’ তবে বসন্ত কেবল প্রেমের ঋতু নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির দ্রোহের ইতিহাসও। এমনই এক বসন্তে বাঙালি ভাষার জন্য আন্দোলন করেছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি ছিল ৮ ফাল্গুন। সেদিন মাতৃভাষার মর্যাদা রাখতে জীবন দিয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের হাত ধরে বাঙালি করেছে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন আর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। সেদিক থেকে দেখতে গেলে বসন্তে রোপিত হয়েছিল বাংলাদেশের জন্মের বীজ। দ্রোহ হোক বা প্রেম, বসন্ত আমাদের জীবনে বয়ে নিয়ে আসে নতুন আশা। রুক্ষ শীত শেষে বসন্তের আগমনে প্রকৃতিতে জাগে নতুন আনন্দ। এবারের বসন্ত নতুন জীবনীশক্তিতে প্রকৃতি ও প্রাণকে ভরিয়ে তুলুক। বসন্তের দোলা লাগুক বনে, মনে। উল্লসিত মন গেয়ে উঠুক, ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।’