আইন অমান্য করার সংস্কৃতি সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে’

0
13

প্রতিদিনের ডেস্ক
‘জনগণ আইন বা নিয়ম ভাঙছে রাষ্ট্র বা সরকারের কাছ থেকে শিখে। সরকার আইন-নিয়মের পরোয়া করছে না। নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে এ দুরবস্থা বারবার প্রমাণিত হচ্ছে। যে কারণে সবাই আইন অমান্য করার চেষ্টায় লিপ্ত। এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রক সংস্থা দিয়ে দূর করা সম্ভব নয়।’বলছিলেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। রাজধানী ঢাকায় অগ্নিকাণ্ড ও জনজীবনের নিরাপত্তা নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তিনি।শাহদীন মালিক বলেন, ‘আমরা এক মহাসংকটের দিকে যাচ্ছি। সহসাই এ অবস্থা থেকে মুক্তি নেই। আইন দিয়েও আপনি এ সংকটের উত্তরণ ঘটাতে পারবেন না। ধরুন, রাজধানীর মানুষ মনে করলো যে নর্দমার পানি খাওয়া যায় এবং মানুষ তা খাওয়া শুরু করলো। তাহলে ২০ লাখ পুলিশ নিয়োগ করেও কিন্তু আপনি এই পানি খাওয়া ঠেকাতে পারবেন না।’
‘একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভোট, নির্বাচন হচ্ছে প্রধান নিয়ামক, যার মাধ্যমে জনগণ তাদের শাসক নির্বাচন করে। জনগণ কি এই নিয়ামক পাচ্ছে। পদোন্নতি, বদলি, নিয়োগ সবই তো এখন নিয়মের বাইরে। মানুষ তো তার নাগরিক দায়বদ্ধতা ভুলে গেছে।
দুই লাখের ওপরে হয়তো পুলিশ সদস্য। সবাই আইন লঙ্ঘনের উৎসবে থাকলে এই দুই লাখ পুলিশ দিয়ে সামলানো সম্ভব? ঢাকা শহরে হাজার হাজার বাড়ি। অধিকাংশ বাড়িই নিয়ম ভঙ্গ করে তৈরি করা হয়েছে। অন্যকে দোষ দেওয়ার আগে তো নিজের দিকেও তাকাতে হয়। যেদিক দিয়ে রাস্তা পার হতে হয়, সেদিকে না গিয়ে আমি চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে পার হচ্ছি। যেখানে ফাঁক পাই, সেখান দিয়েই দৌড় দেই। নাগরিকদের এই দায়িত্বহীন আচরণ থাকলে সরকারি সংস্থা দিয়ে আপনি দূর করতে পারবেন না।’
মানুষ ক্রমশই দায়িত্বহীন হয়ে উঠছে কি না? এর কারণ হিসেবে রাষ্ট্র এবং সরকারকেই দায়ী করেন ড. শাহদীন মালিক। বলেন, ‘আপনি দেখেন তো রাষ্ট্রের কোন জায়গায় সঠিক আইন মানা হচ্ছে? নিয়ম না ভাঙলে চাকরি হয় না। তদবির না থাকলে বদলি, পদোন্নতি হয় না। সার্বিক নিয়ম-শৃঙ্খলা অমান্য করার যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে এরকম অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা চলতেই থাকবে।
১২ বছরের একটি ছেলে যখন দেখে যে তার বাবা যে বেতন পায়, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ব্যয় করে, সেই ছেলে সৎ হবে এটি চিন্তা করা অবাস্তব। সরকার নিয়ম-কানুনের কোনো তোয়াক্কা করে না। তোয়াক্কা না করায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। তাহলে আপনি নাগরিককে নিয়ম মানায় অভ্যস্ত করতে পারবেন না। আপনি জনগণকে মানতে বাধ্য করতে পারবেন না। মানুষ নর্দমার পানি খাইতে চাইলে বন্ধ করতে পারবেন না।’
নিয়ম ভাঙার এই মানসিকতা নিয়ে আমরা আসলে যাচ্ছি কোথায়? এমন প্রশ্নের উত্তরে সিনিয়র এই আইনজীবী বলেন, ‘আমরা যাচ্ছি কোথায় তা স্পষ্ট। মানুষ জানছে, আইন না মেনে সবকিছুই করা সম্ভব এই দেশে। মানুষ ভোট না দিলেও ক্ষমতায় থাকা যায়। যোগ্যতা না থাকলেও পদ পাওয়া যায়, মন্ত্রী-এমপি হওয়া যায়। সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করতে আপনাকে ঘুস দিতে হয়। একজন মানুষ ছোটবেলা থেকেই এই চিত্র দেখে বড় হচ্ছে। সবাই ধনী হওয়ার জন্য উম্মাদ হয়ে পড়ছে। পাশের জন তো বসে থাকবে না। তিনিও যে কোনো পথে ধনী হওয়ার চেষ্টা করবেন।’
‘নির্বাচনের আগে আমরা দেখলাম, একজন এমপি পাঁচ বছরে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এজন্য কোনো জবাবদিহিতার প্রয়োজন মনে করেন না। তাহলে আমি এক বা দুই কোটি টাকা আয়ের জন্য একটু অনিয়ম করতেই পারি। এ ধারায়ই চলছে দেশ।
আইন অমান্য করার সংস্কৃতি সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। সরকার মানে সরকারের সঙ্গে সংযুক্ত ক্ষমতাসীনরা এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তখন সাধারণ মানুষও এই নীতি অনুসরণ করবে। নিয়ম-কানুন মেনে হঠাৎ কোটিপতি হওয়ার উদাহরণ কমই আছে।’
সংকট উত্তরণে আসলে কিছুই আর করার নেই উল্লেখ করে এই বিশ্লেষক বলেন, ‘আমাদের মতো মারামারি, হানাহানি চলছে প্রায় ৩০টি রাষ্ট্রে। আমরা এখন ফিলিস্তিন, গাজা নিয়ে মেতে আছি। আমরা ইয়েমেনে হুথিদের আক্রমণের কথা শুনছি। কিন্তু গত ৮ বছরে ইয়েমেনে প্রায় দেড় লাখ মানুষ মারা গেছে গৃহযুদ্ধে। এ খবর আমরা রাখিনি। যেসব দেশে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেসব দেশে জনভোগান্তি চরমে এবং এটিই স্বাভাবিক।
এখান থেকে বের হওয়ার সহজ কোনো রাস্তা নেই। দেখুন, বায়ুদূষণে মাসের পর মাস শীর্ষে অবস্থান করছে। এ নিয়ে সরকারের কি আসলেই কিছু করার নেই। সরকারের কোনো মহলকে কি বলতে শুনেছেন, আমরা বায়ুদূষণ রোধে এই এই ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমার চোখে পড়েনি। সরকারের উদাসীনতায় জনগণ উদাসীন হবে খুবই স্বাভাবিক। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, সরকার কখন আইন মানা শুরু করবে। ততদিনে আমাদের এভাবে জীবন্ত পুড়েই মরতে হবে!’