বিশাল অর্থনৈতিক চাপ বহন করতে পারবো তো?

0
18

ড. মাহবুব হাসান
গলার রগ আর গাল ফুলিয়ে যে সরকারের মন্ত্রী ও নীতিনির্ধারকরা বলেন শেখ হাসিনাই কেবল পারেন দেশের উন্নয়নের নিখিল তৈরি করতে- তারা কতটা সত্য বলেন আর কতটা মিথ্যা সেখানে যুক্ত আছে, সেই তলটা আমরা খুঁজে দেখি না। কারণ, আমরা নেতা-নেত্রীদের কথাই বিশ্বাস করি। তারা তো সত্য বলেছেন।
যা কিছু উন্নয়নের শির দেখা যায়- এই যেমন পদ্মা সেতু,তার সঙ্গে রেললাইন সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল, টাঙ্গাইলের বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে নতুন করে নির্মিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু রেল সেতু,কক্সবাজারের মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা কক্সবাজার রেলওয়ে, বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেস হাইওয়ে, ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গ সড়কপথ নির্মাণ, কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পর আমাদের দেশে তো রফতানিযোগ্য বিদ্যুতের পরিমাণ ব্যাপক উন্নতি হয়েছে ( তবে ভাড়া বা রেন্টাল কেন্দ্রগুলো এ হিসাবের বাইরে),পাবনায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, বিআরটি এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল- একটার পর একটা উন্নয়নের যজ্ঞ তো শেখ হাসিনার সরকারই করতে পারে, আর কোনো সরকারের পক্ষে তো এ-রকম উন্নয়নের নজির নেই। এসবই সত্য, চরম সত্য বলে যাকে আমরা মার্কা দিই, এ হচ্ছে তাই।
এই উন্নয়নের ধাক্কায় ঢাকার বায়ু কেবল ধূলিসাৎই হয়নি, পৃথিবীর মধ্যে এখন দূষণে এক নম্বরে চড়ে বসেছে। সেখান থেকে যে নিচের দিকে নেমে আসবে, সে উপায় নেই। কারণ দেশে তো চলছে উন্নয়ন কাটাছেঁড়া, ধুলাবালি, কেমিক্যাল পার্টিকেলসের অতি সূক্ষ্ম উপাদান, যা আমাদের উন্নয়নে বিভোর হার্টের ও ফুসফুসের ছিদ্রগুলো সিল মেরে দেওয়ার জোগাড় হয়েছে।
উন্নতি চাইলে তো কিছু ড্র-ব্যাক আছেই, সে কারণেই চরম দুর্ভোগ তো পোহাতেই পারি আমরা। মন্ত্রীরাও তো এই ধুলাসমৃদ্ধ মহানগরেরই বাসিন্দা। তারা তো টুঁ-শব্দ করেন না। না, মাঝে মাঝে করেন। এই যেমন ২১ মার্চ সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কারও প্রশ্নের জবাবে বললেন আমি তো মন্ত্রী, বাসে তো রং করতে পারি না।
মানে এই কসমোপোলিটন মহানগরের স্মার্ট যাতায়াত পথে যেসব বেসরকারি বাস চলাচল করে তার ৯০ শতাংশই এমন ছাল-বাকল তোলা, নোংরা সিট, ভাঙাচুড়া আসন আর কুৎসিৎ ভাষী কন্ডাক্টরের আওয়াজ ঠিক মানায় না। যেমন মানায় না,মন্ত্রী কেন বাসে রং লাগাতে যাবেন, এই কথাও? কিন্তু বাসের মালিকরা কেন মন্ত্রীর পিছে বসে হাসেন?
এসবই উন্নয়নের রগরগে উপাত্ত। আমি দোষ দেবো না সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে। তিনি এক সময় সাংবাদিকতা করতেন বাংলার বাণী পত্রিকায়। মানে তিনি গণমানুষের প্রতিনিধি অনেক আগে থেকেই। সেই তিনি যখন বলেন তিনি কি বাসে রং লাগাতে পারেন? পারেন না।
তিনি যা পারেন, তা কেন করেন না? তিনি তো বাসমালিকদের বলতে পারেন, কাল থেকে কোনো ঝক্করমার্কা বাস রাজধানীতে চলবে না। অথবা বলতে পারেন, এক সপ্তাহের মধ্যে প্রত্যেকটি বাস-মিনিবাসে সুশোভন রং করে রাস্তায় নামাতে হবে। তার কথায়ই তো মালিকরা কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, তিনি সে কথা বলেন না। আমাদের স্মার্ট মহানগরে লক্করমার্কা বাসই চলাচল করতে থাকে। এবং থাকবেই। এবং চলতেই থাকবে, থাকবেই, থাকবেই।
সেই অনুষ্ঠানে দেখলাম তার পাশে বসে আছেন বাসমালিক ও শ্রমিক নেতা, সাবেকমন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি মন্ত্রীর কথায় মাথা দোলালেন। মানে তিনি ঠিক বলেছেন। আমাদের বড় সমস্যা হচ্ছে আমরা মুখের ওপর সত্য বলতে সংকোচ বোধ করি। বলতে পারি না। ওই সব লক্কড় বাসের মালিকদেরই তো প্রতিনিধি শাজাহান খান।
তিনি এবং তারা যা চাইবেন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তার বাইরে যেতে পারবেন না। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে যেমন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র নামক আওয়ামী লীগ নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছে, এখানেও নিজেরাই মালিক, নিজেরাই শ্রমিক নেতা। আর নিজরোই লক্কর বাস চালায় মহানগরের সড়কে। স্মার্ট রাজধানীর স্মার্ট বাস-মিনিবাসের মালিকদের এই অভিযাত্রা কে না জানে?
দুই.
ইআরডি ও বাংলাদেশ ব্যাংক হাসিনা সরকারের উন্নয়নের গোমর ফাঁস করে দিয়েছে। গত ১৫ বছরে সরকার বিদেশি ঋণ নিয়েছে ৭৯ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। আর বেসরকারি খাত বিদেশি ঋণ নিয়েছে ২০ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন। এই দুই খাত মিলে বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০০ বিলিয়ন দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার। ১৩ বছর আগে যখন হাসিনা সরকার ক্ষমতায় তখন বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ২০ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষেও বিদেশি উৎস থেকে সরকারি ও বেসরকারি খাতের মোট ঋণ স্থিতি ছিল ৪১ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৩৪ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার ছিল দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। বাকি ৬ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ ছিল স্বল্পমেয়াদি।
ওই সময় বিদেশি ঋণ ছিল দেশের মোট জিডিপির ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর থেকে বিদেশি ঋণ ক্রমাগত বেড়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে এ ঋণের স্থিতি ৫৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৬২ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারে।
বিদেশি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ২০১৮ সালের পর। ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ৬৮ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধি ১৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ওই অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৮১ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলারে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয় ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থবছর শেষে এ ঋণের স্থিতি ৯৫ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।
এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ থেকে বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠান স্বল্পমেয়াদি ঋণ প্রত্যাহার করে নেয়। এতে বিদেশি ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধিও কমে যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ৯৮ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। আর গত বছর শেষে এ ঋণের স্থিতি ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।
(প্রথম আলো/ ২২মার্চ , ২০২৪)
ঋণ নেওয়া কখনোই ভালো কোনো বিষয় নয়। ঋণ নিয়ে উন্নয়ন করার মানে দাঁড়াচ্ছে, ওই ঋণের সমুদয় দায় দেশের জনগণের ওপর চেপে বসে। এটা সাধারণ মানুষ বোঝে না। তারা জানেও না যে গত ১৩ বছরে সরকার কতো পরিমাণ বিদেশি ঋণ তাদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে।
সাদা চোখে দেখলে এই ঋণের চাপ জনগণ অনুভব করে না। কিন্তু তারা এটাও বোঝে না যে সরকার ওই ঋণের টাকায়, গত ১৩ বছরে কি কি কাজ করেছে। উপরে যে উন্নয়নের তালিকা লিখেছি সেগুলো করতেই যে ওই ১১ লাখ কোটি টাকা খরচ হয়েছে, তা আমরা ধরে নিতে পারি। কিন্তু ওই পরিমাণ টাকায় তো আরও বহু কাজ হতে পারতো। হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নির্মাণ সেক্টরে বাংলাদেশে ব্যয় তিনগুণ বেশি। ভারতের চেয়েও ডাবল। পাকিস্তানের মতো একটি রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল দেশের নির্মাণ সেক্টরের ব্যয় অনেক কম। এমনকি গত পরশু যে তথ্য বেরিয়েছে তাতে সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান তলানিতে। ভারত পাকিস্তানও আমাদের অনেক ওপরে আছে। এত সব উন্নয়নের পরও মানুষকে সুখী করতে পারেনি সরকার। তার কারণ সরকার খোলামকুচির মতো ঋণের টাকা ব্যয় করেছে।
প্রকৃত উন্নয়ন তো জনগণকেন্দ্রিক হওয়ার কথা ছিল, মানে কৃষি সেক্টরের উন্নয়ন, সেখানে যৎসামান্যই হয়েছে। অভিযোগ তো খণ্ডানো যায়, কিন্তু প্রকৃত সত্য কি লোকানো সম্ভব? কোনো না কোনোভাবে তা বেরিয়ে আসবেই। ইআরডি আর বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে বেরিয়ে এসেছে যে সরকার কোন কোন বছর সব থেকে বেশি ঋণ নিয়েছে।
এই অতিরিক্ত ঋণের চাপ খোলাবাজারে কীভাবে পড়ে তা অর্থনীতিবিদরা ভালো বলতে পারেন। আজ কাঁচাবাজারে খাদ্যশস্য থেকে শুরু করে কোনো পণ্যই সাধারণের কেনার সামর্থ্যের মধ্যে নেই। যারা দিন এনে দিন খায় এমন কোটি সংখ্যারও বেশি মানুষের দমটা গলার কাছে এসেছে। সরকারের উন্নয়ন তারা অনুভব করতে পারে না। এমনকি সরকার যে খোলাবাজারকেও নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে এ সত্য আমরা জানলেও তা জনগণের সামনে বলি না। কারণ, আমরা সত্য বলতে ভয় পাই। আর সত্য এমন এক নির্মম যা ক্ষমতাবানরা সহ্য করতে পারে না।
সরকারের জবাবদিহিতার কথা আমরা বলি। জাতীয় সংসদেই মূলত সরকার তার কাজ-কর্মের জবাবগুলো উপস্থাপন করেন। কিন্ত্র এবারকার সংসদ তো নির্মিত হয়েছে এসো আমরা করি টাইপে। আমরাই সরকারি দল, আমরাই বিরোধী দল। বিএনপি নামক বিরোধী দলের অস্তিত্ব বিলোপ করে দাও, তাহলে কাউকে জবাবদিহি করতে হবে না। এ কারণেই সকাল-সন্ধ্যা সরকারি নেতারা বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিষ্দোগার করেন।
সরকার যখন চলে যাবে, যাবে কি না তা আমরা বলতে পারি না, তখন কি এই সরকারি প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলারের বোঝাটা কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে যাবেন? নাকি তা জনগণের কাঁধে হিমালয়ান চাপ হিসেবে রেখে যাবেন? উন্নয়নের এই বিশাল অর্থনৈতিক চাপ আমরা বহন করতে পারবো তো?
লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।