আমিনুল ইসলামের প্রেমের কবিতা: বহুমাত্রিক এবং অনন্য

0
17

প্রতিদিনের ডেস্ক:
জোয়ানা জেসমিন
একটি মানব মন একটি আস্ত ভূগোল। এ যেন সীমার মাঝে অসীম প্রবাহ। প্রকৃতির মতোই এখানে জোয়ার আসে, দুকূল ছাপিয়ে আসে বন্যা, সে তোড়ে নিজে ভেসে চলে, ভাসিয়েও যায়। এভাবেই চলে স্রোতের টানে লক্ষ্য অভিমুখে ছুটে চলা, কখনো পাড়ে লেগে, কখনোবা পাড় ভেঙে। আর আবেশের উৎসারিত এ ধারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকর্ষণ করে প্রতিনিয়ত, চুম্বকের ন্যায় টেনে রাখে অপর কোনো প্রান্তে। এ অনুভবের নামই প্রেম। বিন্দু হতে বৃত্ত অভিমুখে এ অনুভূতির গন্তব্য। প্রকৃতির প্রবাহের সাথে মিলে যাওয়া এই গতিময় প্রেমও জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে, সজীব আবহে ভরে তুলতে পারে পাঠকের মন, প্রেমের কবি আমিনুল ইসলামের কবিতায় সে সত্যই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে প্রতি শব্দের খেলায়। যান্ত্রিকতার ব্যস্ত পথচলায় ক্রমশ একের পর এক বোঝা বেড়ে চলে সময়ের পরিক্রমায়। মানব জীবনে এই বয়ে চলা আর বেড়ে চলার সমন্বয়ে যে ক্লান্তি জমে ওঠে তা সাথে সাথে যদি প্রশমিত হতো, তবে অনাবিল আনন্দে ভরে উঠতে পারতো যাপিত জীবন। মানব মনের এ অস্থির দোলাচলে নিজেকে পুড়িয়ে কবি তার অনুভবের বর্ণ সাজিয়ে যখন পাঠককে উপহার দেন কবিতা, সে কবিতায় পাঠকও খুঁজে ফেরেন নিজেকে। কবিতার জগতে নান্দনিকতা, উপমা, চিত্রকল্প, প্রকৃতি-প্রেমের ব্যঞ্জনায়, আধুনিক রোমান্টিকতায়, মৌলিকতার এক অনন্য মাত্রায় নিজ পথ ধরে হেঁটে চলা, স্বতন্ত্র একজন কবি আমিনুল ইসলাম।কবিতা হৃদয়ের কথা বলে, কবিতার বাণী হৃদয়কে স্পর্শ করে। যে কবিতায় একটি শব্দের পর আর একটি শব্দ শোনার ইচ্ছায় শ্রবণেন্দ্রীয় সজাগ থাকে, উথাল-পাথাল ঢেউয়ের মতো বয়ে যায় উষ্ণশ্বাসের স্পন্দন, সে কবিতা হৃদয়স্পর্শী কবিতা, সে কবিতা চিরন্তন সুখের উৎস হিসেবে বিবেচিত। কবি আমিনুল ইসলাম হৃদয়স্পর্শী কবিতার কবি। তাঁর কবিতার উচ্চারণে পাঠকেরও অন্তঃকরণে বেজে ওঠে, আমারও কিছু বলার ছিল। কবিতার মাঝে তখন মূর্তমান হয়ে ওঠে চেনাশোনা ব্যথা, দুঃখবোধ, প্রেম আর তিয়াস। হৃদয় ছুঁয়ে দিয়ে ‘প্রণয়ী নদীর কাছে’ কাব্যগ্রন্থের ‘ইহাও এক প্রকারের ভালোবাসা’ কবিতায় কবি উচ্চারণ করেছেন—
‘আর এই তুমি ঝাড়বাতি আর জোছনার পার্থক্য বোঝো না
বোঝো নাকো—অধর ও হাসি কখন উজ্জ্বল উৎপ্রেক্ষা হয়
প্রতিদিন শেকলে প্রণাম দিয়ে শুরু হয় রতিক্লান্ত সকাল
আর নিষ্ঠাহীন সাংসদের মত পদখানি ধরে রাখতে
মাঝে মাঝে খেলতে আসো নান্দনিকতার গন্দম বাগানে!’
কবিতার বিষয়, উপমা, চিত্রকল্প আর আবেগের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে নান্দনিকতা। নান্দনিকতার বিচারে কবি আমিনুল ইসলামের কবিতা অনন্য। এখানে সম্মিলন ঘটেছে প্রকৃতি আর প্রেমের, সভ্যতার প্রাচীনত্ব আর নতুনত্বের। তাঁর কবিতায় নতুন শব্দের সাবলীল ব্যবহার আর চিত্রকল্পের মায়ায় পাঠক তাই নিজের অজান্তেই বাঁধা পড়ে যায় কবির সাথে, কবিতার সাথে। চলমান বিশ্বের সুখ-দুঃখও যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে কবি আমিনুল ইসলামের কবিতায়। কবিতা যেন তখন হয়ে ওঠে হারিয়ে যাওয়া গান, কবিতা তখন হয়ে ওঠে প্রেমপূর্ণ পৃথিবীর মায়া, যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ে বোশেখের বরেন্দ্রভূমির শুষ্ক মাটিতে প্রাণের জোয়ার। দুটো মানুষের মনের আকুতি, অভিমান আর ভালোবাসার বর্ষণ দুজন ছাড়িয়ে ছড়িয়ে যেতে থাকে, বিস্তৃত হতে থাকে বিশ্বময়। কবির কবিতার ভাষায়—
‘হয়তো-বা ভুল সময়ে জন্ম আমার
হয়তো-বা সময় করেছে ভুল—
ক্যালকুলেটর সময়ে জন্ম দিয়ে
এই আমাকে—
যার চোখে অলোভনীয়
বিল গেটসের ডলারের হিমালয়ী চূড়া
কিংবা
জর্জ বুশের সভ্যতার যৌনভেদী যুদ্ধলিঙ্গ
বারুদবীর্য টমহক—
গ্যাং রেপেও যার রয়েছে
অঘোষিত দায়মুক্তি
ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে!’
(‘প্রেম অথবা প্রার্থনা’, প্রণয়ী নদীর কাছে)
এই কবিতার মাঝে কবি যে প্রেমময় সত্তার প্রতি নান্দনিক ভালোবাসার অনুভবে চলমান বিশ্বকে সিক্ত করতে চেয়েছেন, তাকে উদ্দেশ্য করে তাই বলেছেন—
‘মাঝে মাঝে একা একা ভাবি—
মাঝে মাঝে কৌতূহল
প্রণয়ের পার্লামেন্টে
তারকাচিহ্নিত প্রশ্ন হয়ে
গরম করে তোলে শীতকালীন
একপক্ষীয় সান্ধ্য অধিবেশন:—
যে-অধর থেকে উঠে আসে
এই মধুহাসি,
যে ঠোঁট ছুঁয়ে
ঝরে পড়ে বরেন্দ্রীর
গুড়মাখা গুঞ্জরন
সুগারকোটেড শব্দাবলি,
তার চারপাশে কি উড়ে বেড়ায়
প্রতিবেশী মৌমাছির ঝাঁক!’
(‘প্রেম অথবা প্রার্থনা’, প্রণয়ী নদীর কাছে)
কবি আমিনুল ইসলাম দুর্দান্ত ও দুঃসাহসী প্রেমের কবি, প্রেম মানে কবির কাছে কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য কিংবা কোনো সীমাবদ্ধ ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ নয়। যে প্রেমে খোলা আকাশের বিস্তৃতি নেই, যে ঢেউয়ে সামনে চলার স্বাধীনতা নেই, সেই প্রেম হয়তো কবিকে প্রকৃত প্রেমের আনন্দ দিতে পারে না। তাঁর প্রেম পৌরুষদীপ্ত, ভীরুতামুক্ত এবং সব ধরনের ক্ষুদ্রতা ও তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে। ‘প্রণয়ী নদীর কাছে’ কাব্যগ্রন্থের ‘আস্ত নদীটাই আমার চাই’ কবিতায় কবি কলমের আঁচড়ে সেই স্বাধীন, স্বকীয় প্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে লিখেছেন—
‘আমিও ভালোবাসি ঐ যুবতি নদীকে যে আজও
আমাকে সাঁতারের অধিকারে দেয়নি বলে
নিষিদ্ধ পুলিনে দাঁড়িয়েই দেখি তার
চুলখোলা নবায়নী নান্দনিকতা।’
(‘আস্ত নদীটাই আমার চাই’, প্রণয়ী নদীর কাছে)
কবির কাছে প্রেম মানে সজীবতায় পূর্ণ পৃথিবী যেখানে অক্সিজেনের দোলা আর অনুভবে সবুজ থাকে মনের আঙিনা, হৃদয় আচ্ছন্ন হয় রাগ-অনুরাগে। প্রেমের নিষ্কলুষ অনুভূতি অপার মিষ্টতায় ভরায় চারপাশ। কবি প্রেমের স্নিগ্ধ, মিষ্টি অনুভবের অভাব সইতে পারেন না বলেই এ কবিতায় বলেছেন—
‘অথচ তার কুলকুলধ্বনি না শুনলে আমার ঘুম আসে না রাতে
তার জলছোঁয়া হাওয়া যদি ছুঁয়ে না যায় অন্তরঙ্গ আঙিনা,
অক্সিজেন স্বল্পতায় বিবর্ণ হয়ে ওঠে চিন্ময় জোতের বাগান।’
(‘আস্ত নদীটাই আমার চাই’, প্রণয়ী নদীর কাছে)
কবি আমিনুল ইসলাম কেবল দুর্দান্ত প্রেমের কবিতা লেখেন কিংবা হৃদয়স্পর্শী কবিতার কবি নন বরং তিনি অত্যন্ত দুঃসাহসী কবি। কবিতার চরণে প্রেমিকার প্রতি কবির এই দুঃসাহস পাঠককেও দুঃসাহসী করে তোলে। কবির মেঘনাপাড়ের প্রেমিকা কারো ঘরণি, কিন্তু জাল আর জলার সূত্রে সে কবির প্রেমিকার স্রোতস্বিনী রূপকে আটকে রাখতে পারে না। সে আটকে থাকা এক যুগ হলে কী হবে? কবি তার চুলখোলা নবায়নশীলতাকেই দেখতে চান। কবিতাটি নিঃসন্দেহে রূপক কবিতা যার মাঝে কবি নারী স্বাধীনতাকে উৎসাহিত করতে চেয়েছেন পরম মুগ্ধতায়। বর্তমান সমাজের এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারীর সৃজনশীলতা। নারীর যে আলাদা একটি সত্তা আছে, যে সত্তার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ নারীর আপন পরিচয়কে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে কবি আমিনুল ইসলাম প্রেমের কবিতার মাঝে অত্যন্ত সূক্ষ্ণভাবে ও সচেতনতার সাথে সে বিষয়টির অবতারণা করেছেন। আর প্রেমের কবিতার মাঝে নারীকে স্বাধীন, মেধা ও মননে স্বকীয় অবস্থানে দেখতে চাওয়া এক ধরনের দুঃসাহসও বটে! ‘আস্ত নদীটাই আমার চাই’ কবিতার কয়েক চরণ এখানে উপস্থাপন করা হলো—
‘তাতে ভাঙলে ভাঙুক-মেঘানাপাড়ের ঐ যুবকের স্বপ্নের জল টুঙি যে-
জাল যার জলা তার—এই ফরমুলায় নদীটিকে
দখল রেখেছে একযুগেরও অধিক। যদি উড়ে যায়—যাক উড়ে-
পারঘাটাতে গড়ে ওঠা মৎস্য-মহাজনের আড়ত ও পতাকা!
তো কত আর সিদ্ধান্তহীনতা-পর্যালোচনা-পুনর্বিবেচনা!
পূর্ণিমার প্ররোচনা গায়ে মেখে ক্ষেপে উঠুক আমার সবখানি জল
সে জল উজানে গিয়ে কামড়ে আসুক নদীর স্লিপারি আধার!’
(‘আস্ত নদীটাই আমার চাই’, প্রণয়ী নদীর কাছে)
পাঠককে উৎসাহী ও জ্ঞানপিপাসু করে তোলা কবির অন্যতম গুণ। আর বর্তমান সময়ের যান্ত্রিক জীবনে বইয়ের পাতা থেকে জ্ঞান আহরণে উৎসাহী, পিপাসিত পাঠক সৃষ্টি উল্লেখযোগ্য দাবিও বটে। কবি আমিনুল ইসলামের কবিতা সুখপাঠ্য, সহজপাঠ্য হলেও সরলরেখায় সহজবোধ্য নয়। তাঁর কবিতা অর্থের দিক থেকে বহুমাত্রিক। তাঁর কবিতার শাব্দিক সহজতার আবরণে কঠিন ও গভীর কথা লুকিয়ে থাকে। তিনি প্রেমের কবিতার মধ্যে প্রেম-বাসনার কথা নানাভাবে প্রকাশের আড়ালে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অপ্রিয় সত্যকে উদ্ভাসিত করে তোলেন। জগতের চলমান নানা বিষয়, লেখালেখির মৌলিক জ্ঞান সম্পর্কে পাঠককে জানতে হয়। অন্যদিকে কবিতায় ডুব দিয়ে পাঠক আকৃষ্ট হয়, পিপাসিত হয় আরও কিছু জানার জন্য। তাঁর অনেক কবিতা পাঠে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কঠিন হয় তিনি আসলে পাঠককে কোনো বিষয়ে বার্তা দিতে চেয়েছেন। পাঠকভেদে কবিতার অর্থ ভিন্ন হয়। কারণ যে-পাঠক যেভাবে বুঝতে চান, কবিতার অর্থ সেভাবেই দাঁড়ায়। ‘ভালোবাসার ভূগোলে’ নামক বইয়ের ‘চুম্বন নিয়ে লেখা যে কবিতার সকল চরিত্র কাল্পনিক’ কবিতার একটি অংশে কবি বলেছেন—
‘হে মেয়ে, তুমি তো কবিতা ভালোবাসো; বাসি আমিও।
কিন্তু আজও বোঝোনি, কবির চুম্বন গোপনে
তাজমহল গড়ার যৌথ ফান্ড। আর এই ফান্ডে
বাইরের কন্ট্রিবিউশন গ্রহণীয় নয়,
হোক সে বন্ধুবেশী বিশ্বব্যাংক অথবা
লুটেরা স্থানীয় কোটিপতি।
প্রণয়ের ফান্ডে আমাদেরই দিয়ে যেতে হবে—
ভালোবাসার সিকি, আধুলি, নোট।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী,— রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মহোদয়,
দেখুন—
গরীরের ঘামে রোদ লেগে চিকচিক করছে ভ্যাট,
মুক্তবাজার অর্থনীতির দাগটানা পথ ধরে
দিনদিন বেড়ে চলেছে করের পরিসীমা;
বাড়ুক্! শুধু এটুকু মিনতি-
দয়া করে আমাদের চুমুর ওপর ট্যাক্স বসাবেন না!
রাতরঙা ব্যাগহাতে এক্সটার্নাল অডিট যাক মেগা প্রজেক্টের বাড়ি!’
কবি আমিনুল ইসলামের কবিতা পড়তে গিয়ে নতুন প্রজন্মকে জানতে হয় আরও কিছু। আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকা নানা কবিতা পাঠের। তিনি কবিতায় তুলে ধরেন ইতিহাসকে, অনুভব করেন আপন অস্তিত্বের টান, বাস্তবতার সাথে কল্পনার অদ্ভুত সমন্বয় ঘটিয়ে প্রকৃতি ও প্রেমের, ইতিহাস আর বর্তমানের মেলবন্ধন রচনা করেন কবিতায়। পাঠক হারিয়ে যেতে থাকে, ডুবে যেতে থাকে গভীর থেকে গভীরে, কবিতার সম্মোহনী শক্তিতে মোহিত হয়ে পাঠক এক অন্যরকম রসের আস্বাদনে পূর্ণ হন; ইতিহাসের পরোক্ষ পাঠ দিয়ে রচিত তেমনি এক প্রেমের কবিতা ‘বিজয় সেনের রাজধানী এবং ভালোবাসার রাজকন্যা।’ কবিতাটি তাঁর ‘প্রণয়ী নদীর কাছে’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। কবিতায় উচ্চারিত হয়েছে ইতিহাস বিখ্যাত প্রেমিক প্রেমিকা সেলিম-আনারকলির কথা। সম্রাট আকবরের সময়ে লেখা হয়েছিল ‘মুঘল-ই-আজম’ নামক নাটকটি। আর এই কাহিনি নিয়ে ১৯৬০ সালে কে আসিফ নামের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার এর পরিচালনায় দিলীপ কুমার, মধুবালা এবং পৃথ্বীরাজ কাপুর অভিনীত রোমান্টিক ভারতীয় চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। এ কবিতায় প্রেমের অন্তরালে কবি এক বাঙালি মহিয়সী নারী এবং সংগ্রামী কৃষক নেতা ইলা মিত্রের কথা বলেছেন। ইলা মিত্র ইতিহাস বিখ্যাত তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এছাড়া এ কবিতায় উল্লেখিত জীবনানন্দের বনলতা সেন, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পানিহার লাইব্রেরি, সেন্টার অব গ্রাভিটি পাঠককে ইতিহাস ও বিজ্ঞানের নানা বিষয় সম্পর্কে জানতে আগ্রহী করে তোলে। এ ছাড়া কবি প্রেমের কবিতায় ইতিহাস, ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক স্থান সম্পর্কে তুলে ধরেছেন ‘কুয়াশার বর্ণমালা’ কাব্যগ্রন্থের ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’ নামের সুদীর্ঘ কবিতাটিতে। বাংলার পথে প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য মসজিদ, মন্দির, তীর্থস্থান, জাদুঘর। এসব ঐতিহাসিক স্থানসমূহ কালের বিবর্তনে আজও সগৌরবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। কবি এ কবিতায় আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রেম ও ঘামের সাক্ষী চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ, নাটোরের রানী ভবানীর প্রাসাদ, নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, কুমিল্লার ময়নামতি, চলনবিলের, পু্ণ্ড্রনগরের ইতিকথা, উয়ারী বটেশ্বর ইত্যাদির কথা তুলে ধরেছেন। কবিতায় ইতিহাসের পাঠ পাঠককে সত্যি বিমুগ্ধ করে রাখে। প্রাসঙ্গিকভাবে কবির ‘বিজয় সেনের রাজধানী এবং ভালোবাসার রাজকন্যা’ কবিতার কয়েকটি চরণের উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো—
‘গাড়ির জানালা ফুঁড়ে তোমার আমার নিঃশ্বাস পদ্মা-যমুনার
সম্মিলিত স্রোত হয়ে
মিশে যায় ইলামিত্রের এমবোস স্কেচ আঁকা ভূগোলে।’
কী চমৎকার প্রাণবন্ত ইতিহাস পাঠ যা কবিতাকে অনন্য রূপ দান করতে সক্ষম হয়েছে। এরপর কবি পাঠককে নিবিড় প্রেমে নিয়ে গিয়েছেন অসাধারণ চিত্রকল্পের হাতছানিতে:
‘রবিঠাকুরের মুগ্ধ স্বপ্নের উজ্জয়িনী-প্রিয়া নয়,
জীবনানন্দের ট্যাক্টফুল ভাবনার বনলতা সেন নয় নাটোরের,
একদিন বিজয় সেনের রাজধানীতে দিনের আলোয়
মুখোমুখি হয়েছিলাম আমরা; কোনো পূর্বসূত্র ছিলো না।
তোমার চোখ জুড়ে ছিলো পানিহার পাবলিক লাইব্রেরী
আমার বুক জুড়ে পাঠের পিপাসা।’
ইতিহাসকে আশ্রয় করে দুটি হৃদয়ের না-বলা কথার প্রকাশে চিত্রকল্পের অভিনব ব্যবহার বিদগ্ধ পাঠককে কতটা মুগ্ধ করে তা মূল্যায়নের ভার দুএকটি বাক্যে প্রকাশ রীতিমতো দুঃসাধ্য! চমৎকার এ কবিতার কৃতিত্ব তাই কেবল প্রিয় কবির।কবি আমিনুল ইসলামের প্রেমের কবিতায় নানা উপমা ব্যবহৃত হয়েছে, তিনি প্রেমের সাথে সমন্বয় ঘটিয়েছেন পদার্থবিজ্ঞানের। তার এই আধুনিক মানসিকতার এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর ‘আমার ভালোবাসা তোমার সেভিংস অ্যাকাউন্ট’ গ্রন্থভুক্ত ‘মহাবিশ্ব’ কবিতাটি। আমি বিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে জানি, বিশ্বের প্রতি দুটি বস্তু একে অন্যকে আকর্ষণ করে। একে বলা হয় মহাকর্ষ। আর দুটির বস্তুর একটি পৃথিবী হলে তখন ওই আকর্ষণকে বলে অভিকর্ষ। আমিনুল ইসলাম পদার্থ বিজ্ঞানের এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে নির্মাণ করেছেন নারী-পুরুষের প্রেমের কথা। কবিতাটির মধ্যে আছে আহ্নিক গতি, অভিকর্ষীয় টান, মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র, ভারকেন্দ্র, গ্রহ-নক্ষত্র, কক্ষপথ, মুক্তির বেগ, স্বতঃসিদ্ধ প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক ধারণা। বিজ্ঞানের নীরস সত্যকে এমন চমৎকার ভাষায় উপভোগ্য রূপে প্রেমের কবিতায় ব্যবহার আমাদের বিস্মিত করে। কবিতাটির প্রথমাংশে তিনি বলেছেন—
‘অথচ তোমার জন্য বসে থাকি অজুহাতের স্টেশনে—ইচ্ছাকৃত ফেল করে
আহ্নিকগতির ট্রেন! তুমি আসতে চেয়েছো অথবা চাও—এর বেশি কোনো
কিছুই তো ঘটেনি; তোমার আসতে চাওয়াটা কেন যে এত ব্যঞ্জনা রচে আমার
এলোমেলো ভাবনায়- আমি সেও বুঝি না! তুমি যদি-বা আসোই—সেও তো
নিজ কক্ষপথে ফিরে যাওয়ার জন্যই আসবে,—এতটুকুও রয়ে যাবে না—
রেখে যাওয়ার মতো কিছুই আনবে না সাথে,—তারপরও তোমার জন্য কেন
এই অদ্ভুত অপেক্ষা?আমি তো গ্রহ-নক্ষত্রের ভিড়ের মধ্যেই থাকি যে ভিড়ে অংশ রয়েছে আমারও; এমনিতেই ঝালাপালা এ কান; তো কীসের আবার নতুন ডাক!
অথচ তোমার কণ্ঠ শোনামাত্র কানদুটো ভারকেন্দ্র হয়ে ওঠে! মনে হয়-
মেঘলাকণ্ঠের সিক্তমাধুরী বাড়িয়ে দেয় তোমার মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের পরিধি-
যা ছুঁয়ে ফেলে আমার অন্তরঙ্গ অস্তিত্বের আঙিনা,—বাকি সারাটা সময়
যা রাষ্ট্রীয় ভূগোলের মতো স্থির থাকে বেড়াহীন সীমান্তে ও সীমানায়।’
আমিনুল ইসলাম একজন আধুনিক কবি। একইসঙ্গে আপাদমস্তক একজন রোমান্টিক মানুষ। কবিতায়ও তিনি সে মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। প্রেমের কবিতায় শুধু নির্দিষ্ট কিছু আবেগ, অনুভূতিকে তুলে ধরেন না তিনি বরং কঠিন ও নেতিবাচক সত্যকেও নির্দ্বিধায় স্বীকার করেন। মানবিক সব ঐশ্বর্য ও দুর্বলতা নিয়ে তিনি প্রেমিকার কাছে পৌঁছাতে চান। মানবিক সবলতা দুর্বলতা নিয়েই একজন মানুষ প্রেমিক। তাঁর কবিতায়ও কোনো প্রকার ভণ্ডামি নেই, কোনো দ্বিধা নেই। রোগ, শোক, দুঃখ, ভালোবাসা, ঘৃণার মতো তিনি যাবতীয় পিপাসাবোধকে স্বীকার করেন কবিতায়, আর এখানেই কবির স্বকীয়তা। এ কারণেই তিনি রোমান্টিক হৃদয় নিয়েও আধুনিক মানুষ। কবি তাঁর উপরে বর্ণিত কাব্যগ্রন্থের ‘আমি হতে পারিনি আকাশ’ কবিতায় বলেন—
‘জন্মের পিপাসা নিয়ে এ জীবনে
রাতদিন ভালোবাসা
তুমি হ্যাঁ বলো না, না-ও নয়
শুধু বড়ো দেখতে বাসনা রাখো
অনেক অনেক বড়ো
আকাশের মতো বড়ো
বড় হওয়ার সূত্র তো মুখস্থ জোয়ানা
সেসমস্ত ধরে আছে বাল্যপ্রতিভা
রাজনীতির মেধা নিয়ে
উগরেও দিতে পারি এখনই
‘শোনেন ভাইসব…!’
কিন্তু মাটির হরমোন নিয়ে
কী করে আকাশ হই?’
কবি আমিনুল ইসলামের এক অনবদ্য সৃষ্টি ‘আমার ভালোবাসা তোমার সেভিংস একাউন্ট’ কবিতাটি। কবির দৃষ্টিতে প্রেমের শাশ্বত রূপ প্রকাশ পেয়েছে এই কবিতায়। প্রেমের কবিতার স্রষ্টা হিসেবে কবি ‘আমার ভালোবাসা তোমার সেভিংস অ্যাকাউন্ট’ নামের দীর্ঘ সত্তর লাইনের এ কবিতার মধ্য দিয়ে নিজের প্রেমভাবনাকে এক অনন্য রূপ দিতে পেরেছেন। কবির ভালোবাসা কত উদার, বিস্তৃত কিংবা সংকীর্ণতামুক্ত হতে পারে, কতটা অমূল্য সম্পদ তা জীবনের মণিকোঠায় তাই যেন সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়েছে কবিতার পরতে পরতে। কবিতায় কবি প্রিয়ার প্রতি তাঁর ভালোবাসাকে উকিলের গুরুত্বপূর্ণ রায়ের মতো সযতনে তুলে রাখতে বলেছেন, ছকে বাঁধা জীবনের প্রাত্যহিকতায় বঙ্গোপসাগরের হৈমন্তিক হাওয়ার পরশের অনুভব করতে বলেছেন যেখানে হাঁপিয়ে যাওয়া মুহূর্ত আর সঙ্গম-উত্তর কার্বনগ্যাস নিমেষে উবে যাবে বুদবুদের মতো। যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ, সাংসারিক হিসেব-নিকেশ, মিলন-বিরহ সবকিছুর ঊর্ধ্বে যেন মানব-মানবীর প্রেম। এই কবিতায় কবি বাস্তবতা, কল্পনা, ইতিহাস, রাজনীতি, আধুনিকতা সব রকম উপমার চিত্রায়নে ভালোবাসাকে প্রাঞ্জল করে তুলেছেন। কবিতার অভিনব ভাষা ও ভঙ্গি সম্মোহিত করে গভীরভাবে।
‘আর এতদিন যা বলিনি—আজ তাও শুনে রাখো বন্ধু
মুদির দোকানি হতে পারে না কখনো সপ্তমধুকর ডিঙার সিন্ধু-সওদাগর
পাটিগণিতের পণ্ডিত যে তোমাকে প্রায়শ ফুলমার্ক দিতো
চলিত নিয়মের অংকের অনুশীলনে,—ভেরি গুড!
সে কখনো খুঁজে পায় না বিল গেটস হওয়ার ফরমুলা;
হাজার তৈরি করুক স্কিনটাইট ব্লাউজ-শেমিজ-ব্রা
দরজি কি বানাতে পারে স্বপ্নের শামিয়ানা কিংবা আকাশের বুকের ওড়না?’
দেশে দেশে এই অস্থিরতা, যুদ্ধ বিগ্রহ, অমানবিক, নিষ্ঠুর সময় কবিকে মাঝে মাঝে হতাশ করে। তিনি বিশ্বাস করেন যত আগ্রাসন, দ্বন্দ্ব মতবিরোধ ইত্যাদি সবকিছুরই অবসান হতে পারে পরস্পরকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে। যেখানে দেশে দেশে চলমান যুদ্ধ, হানাহানি বোমাবাজি আর রক্তপাত এর শেষ হয় না (যেমন ফিলিস্তিন-ইসরাইল, ইরাক-আমেরিকার চলমান সহিংসতা), সেখানে সেলফোন আর ইনবক্সে দেশে দেশে ভ্যালেন্টাইন্স ডের নামে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের রোমান্টিক উদযাপনের আদৌ কী ফায়দা থাকে! ‘আমার ভালোবাসা তোমার সেভিংস অ্যাকাউন্ট’ কাব্যগন্থের ‘ভালোবেসে আর কী হবে’ কবিতায় কবি উচ্চারণ করেছেন—
‘ভালোবেসে আর কী হবে প্রেয়সী!
ভালোবাসা কি নেভাতে পারবে
শ্বেত-শয়তানের চুলো—যেখানে
বারুদেও ফুঁয়ে রাঁধা হয় রাতে
তামাটে সভ্যতা-বিরোধী কার্পেট বোমার ডিশ?’
কিন্তু ব্যক্তিগত সাফল্য কিংবা সামষ্টিক অর্জন কোনো কিছুর জন্যই যে ভালোবাসার বিকল্প কিছু নেই। প্রযুক্তির উন্নয়নে, বিনিয়োগের সর্বোচ্চ ফলাফলে, সুশাসন কিংবা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বর্তমান বিশ্বে আমরা যে সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্টের পেছনে হন্যে হয়ে ছুটছি তার জন্যও চাই সাসটেনেবল ভালোবাসার মন। এত সুন্দর করে, এত বাস্তব ভঙ্গিমায় কোনো কবি তার কবিতার পাঠককে নিজ কাজকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন কি না আমার জানা নেই। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের নবনিয়োগপ্রাপ্ত তরুণ কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ প্রশিক্ষণ প্রদানের প্রতিষ্ঠান বিপিএটিসি তথা বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এখানে শেখানো হয় দেশ-বিদেশের নানা বিষয় যা শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার আর নিয়মতান্ত্রিকতার আদলে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীকে তার কর্মক্ষেত্রের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত করে তোলা হয়। কবি সেই বিপিএটিসিকে উদ্দেশ্য করে কবিতা লিখেছেন। কবি আমিনুল ইসলাম যে স্বতন্ত্র প্রেমভাবনায় পাঠকচিত্তে সমুজ্জ্বল তাই যেন ‘বিপিএটিসি তোমাকে’ কবিতার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে—
‘কিন্তু তার আগে চাই ভালোবাসার পাঠ
সাসটেনেবল উন্নয়ন দরকার বটে
সেজন্যই চায় সাসটেনেবল ভালোবাসার মন
ভালোবাসাই সুশাসনের আদিজ্ঞান
ভালোবাসাই সৃষ্টির সর্বোত্তম প্রযুক্তি;
ভালোবাসা মানে বিনিয়োগের সবটুকু সামর্থ্য
ভালোবাসা মানে কোনোখানে কোনো ফাঁকি নেই
ভালোবাসা মানে খোড়া অজুহাতের অনুপস্থিতি
ভালোবাসো মৌরসি পুকুর, ভালোবাসো এজমালি নদী
ভালোবাসো দেশ, ভালোবাসো দুনিয়া
নিপাতনে সিদ্ধিসূত্রে ভালোবাসাই এনে দেবে উত্তম সাফল্য।’
কবিমাত্রই তৃষিত চিত্তের অধিকারী। আপন হৃদয়ের ব্যাকুলতাকে তিনি যেমন ধারণ করেন তেমন তার মনও পুড়ে যায় সৃষ্টির নেশার আগুনে। সৃষ্টির এ তাগিদ কবিকে করে তোলে ভাবুক, কল্পনাপ্রবণ, দুঃখবিলাসী, রাত জাগা পাখি কিংবা পৃথিবীর পথ ধরে হেঁটে যাওয়া ক্লান্ত এক পথিক। কবি আমিনুল ইসলাম জীবন ও জীবিকার তাগিদে হেঁটেছেন স্বদেশের মতো বিশ্বের নানা জায়গায়। কোনো অংশকেই তিনি জীবনের পরিমণ্ডল থেকে বাদ দেননি বরং সবটাই সযতনে তুলে ধরেছেন কবিতার পাতায় পাতায়। ক্ষণিকের ভ্রমণপথের ভালোলাগা নিয়ে, সভ্যতার একযুগ থেকে আরেক যুগের কল্পনার সাথে মিশে গিয়ে কবির অসাধারণ এক প্রেমময় কবিতা ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’ কাব্যগ্রন্থের ‘তুর্কি মেয়ের জন্য’ কবিতাটি। যাকে নিয়ে লেখা তিনি হয়তো জানেন না কিংবা এ ভ্রমণপথের পর তার সঙ্গ লাভ করবেন না কবি, তবু তৃষিত হৃদয়ের সবটুকু উজাড় করে দেওয়া এ সৃষ্টি স্থান, কালের পরিধি অতিক্রম করে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রবে চিরকাল।
‘হে গাজির দেশের মেয়ে- আমি জানি তুমি আমার সোনার বাংলা হবে না;
সহযাত্রীদের রাক্ষসমূর্তি চোখের পাহারা ছিল বলে টুকে নিতে পারিনি
তোমার পোস্টাল ঠিকানা কিংবা ই-মেইল অ্যাড্রেস; আর সেলফোনটি তো
তুমি তোমার হৃদয়ের সাথেই সযতনে রেখেছিলে উভেন-উলের আড়ালে;
জানো- ভালোবাসার প্রতিপক্ষ সবাই; আর আমি এও জানি-তোমার প্রতি
আমার এ অনুরাগ- স্টাডি ট্যুরের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়; তবু হে তুর্কি যুবতি-
অসম্ভবের পথের মোড়ে স্বর্গীয় ভুলের মত তোমার হাতখানা হাতে নিয়ে
সন্দেহপরায়ণ ক’টি ক্যামেরার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ‘হারান’-এর কিংবদন্তির
নকল রাজা সেজেছিলাম; পাশে তুমি দাঁড়িয়েছিলে রানি।’
কবির সুখে-দুঃখে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে, খরায়-সজীবতায়, জীবনের সব রকমের শীত-বসন্তে ভালোবাসার উজ্জ্বল কবিতা ‘আমাদের ভালোবাসার দিন’ কবিতাটি। অসাধারণ চিত্রকল্পের ব্যঞ্জনায় রচিত কবিতাটিতে প্রকৃতি আর ভালোবাসা যেমন সমান্তরাল হয়েছে; তেমনি প্রেম-প্রণয়ের গন্ধে ও তাপে পৃথিবীও উষ্ণতার সন্ধান পেয়েছে। এই কবিতায় ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়ার সাথে কবির কলমে উঠে এসেছে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, বি-ফিফটি-টুর মতো শব্দও। এই কবিতায় কবির শব্দ চয়নে অতি আধুনিকতা, দ্বিধাহীনতা ও উদারতার প্রকাশ পেয়েছে।
কবিতার কাঠামো, পথচলা, গন্তব্য ইত্যাদি সবকিছুই অবশ্যম্ভাবীভাবে নির্ভর করে কবির দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতার ওপর। একজন কবির জীবনদর্শনই তার কবিতা। কবি আমিনুল ইসলাম তাঁর ‘কবিতাসমগ্র’র ‘আমার কবিতা: কাছের কেন্দ্র দূরের পরিধি’ শীর্ষক ভূমিকায় নিজের প্রেমের কবিতার বিষয়ে বলেছেন, ‘প্রেমের কবিতাগুলো প্রচলিত প্রেমের কবিতার চেয়ে কিছুটা আলাদা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর একগানে বলেছেন যে তিনি যখন গানের ভিতর দিয়ে জগতকে দেখেন তখনই সে জগতকে সঠিকভাবে জানতে এবং চিনতে পারেন। আমি প্রেমের ভিতর দিয়ে জীবন ও জগতকে দেখার চেষ্টা করে আসছি; তবে রোমান্টিকতার চোখ ও মন নিয়ে নয়। একবিংশ শতাব্দীর উঠোনে দাঁড়িয়ে অতোটা রোমান্টিক হয়ার সুযোগ নেই যুক্তি তো নেই-ই।’কবির অন্তর্দৃষ্টিতে আরও একটি বিষয় তাঁকে নাড়া দেয়—কোনো একটি ব্যর্থতাবোধ, যা আমার কাছে এক তীক্ষ্ণ মানসিক তাড়না বা অনুভূতির সংবেদনশীলতা মনে হয়। গভীর এক শূন্যতার অনুভব বা বেদনাবোধ কবিকে প্রেমিক করে তোলে, করে তোলে সৃষ্টিশীল। কবি নজরুলের সেই হৃদয়হরণকারী গানের কথার মতো—
‘সবাই তৃষ্ণা মেটায় নদীর জলে,
কী তৃষা জাগে সে নদীর হিয়া-তলে—
বেদনার মহাসাগরের কাছে করো সন্ধান।’
কবির প্রেমের কবিতা বিষয়ে গবেষক-প্রাবন্ধিক সরকার আবদুল মান্নান বলেছেন, ‘প্রেমের কবিতার একটি প্রথাগত রূপৈশ্বর্য ও বিষয়বৈভবের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। বিচিত্র অনুষঙ্গে মানব-মানবীর লীলালাস্যই সেখানে মুখ্য। আমিনুল ইসলাম মোহন প্রেমের এই প্রথাগত আখ্যান রচনা করেন না। সংঘাতময় জীবনের বিচিত্র ক্ষতকে তিনি তুলে ধরেন জীবন-প্রেমিকের বিস্ময়কর অন্তর্লোক থেকে। ফলে নারী নয়, পুরুষ নয়, আটপৌরে প্রতিদিন নয়—বরং এসবকিছু নিয়েই সৃষ্টি হয় তাঁর প্রেমের কবিতার প্রবল জীবন-তৃষ্ণা। প্রচণ্ড এক সংবেদনার মধ্যে কবি আমিনুল ইসলামের কবিতা প্রাণময় হয়ে ওঠে। এই সংবেদনা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রেমের সীমা অতিক্রম করে যায় অবলীলায় এবং ইতিহাস, ঐতিহ্য, লোকজ্ঞান ও লোকজীবন তাৎপর্যপূর্ণ সফলতায় ধরা দেয় কবির প্রেমভাবনার অবয়বে। ফলে পালটে যায় পরিচিত ডিকশন, প্রবল প্রতাপান্বিত ফর্ম। আর সেই বিচূর্ণ কবিভাষার সমাধিস্থলে গজিয়ে ওঠে আমিনুল ইসলামের প্রেমের কবিতার নতুন এক ভাষিক জগৎ, স্বতন্ত্র এক গঠনসৌষ্ঠব। জীবনের প্রতি গভীর মমত্ববোধ আমিনুল ইসলামের কবিতার অন্তর্গত শক্তি। ফলে সমকালের বিচিত্র দুর্দৈবের মধ্যেও তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে অবিনাশী জীবনের গান। বোধের এই সততা ও দায়বদ্ধতায় আমিনুল ইসলামের প্রেমসমগ্র হয়ে ওঠে জীবনসমগ্র—আর্তনাদের মধ্যে আনন্দিত উত্থান।’
কবির নিজের ভাষ্যে ‘লেখালেখি করে যে আনন্দ পাই, তা মহামূল্যবান। জীবন এখন নানাবিধ জটিলতায় আকীর্ণ। যখন অন্যের লেখা পড়ি—আনন্দ পাই; যখন নিজে কিছু লিখতে পারি—তখন আনন্দ পাই আরো বেশি। অতএব লিখে যাচ্ছি। যতদিন বাঁচি লিখে যাবো।’ কবির বহুমাত্রিক প্রেমভাবনার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠুক সংঘাতময় থেকে ভালোবাসাময় পৃথিবী। কবির মতো প্রেমের দৃষ্টিতে ভাস্বর হোক পৃথিবীর কোলাহলবাজ মানুষদের দৃষ্টি। কবি আমিনুল ইসলাম এভাবেই হয়ে উঠুন কালজয়ী এক অধ্যায়ের নাম।