যশোরে বায়েজীদ হত্যাকাণ্ডে জড়িত কিলার রাজন ও রাজু ঢাকায় গ্রেফতার: কিলিং মিশনে অংশ নেন মুল্লুক চাদঁ ও সঞ্জয়

0
16

সৈকত হোসেন
যশোরে সরকার বিরোধী ব্যবসায়ী সিণ্ডিকেটের মূল হোতা মুল্লুক চাঁদ ও তার ভাই সঞ্জয় চৌধুরীর নির্দেশে ও উপস্থিতিতে চাঞ্চল্যকর প্রকৌশলী বায়েজীদ হাসান হত্যা মামলার অন্যতম আসামি হত্যা আব্দুর রহমান রাজন ও রাজু আহম্মেদ ওরফে রাজ ঢাকায় গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ভোরে ঢাকার ঢালীবাড়ী এলাকায় যশোর র‌্যাব-৬ ও ঢাকা র‌্যাব-১ এর দুটি চৌকষ দল অভিযান চালিয়ে মামলার অন্যতম দুই আসামিকে গ্রেফতার করেছেন। গ্রেফতার হওয়া দু জনই প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত আসামিরা জানায়, রফিকুল ইসলাম চৌধুরী (মুল্লুক চাঁন) ও সঞ্জয় চৌধুরীর নির্দেশে ঢাকা বসুন্ধরা আবাসিকের এম ব্লকে বিল্ডিং নির্মাণ প্রকল্পের সাব কন্ট্রাক্টর শহিদুল ইসলামসহ (৪৫) মামলার অন্যান্য পলাতক আসামিরা ২৪ মার্চ ভিকটিম বায়েজিদ হাসানের নিকট টাকা পাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে ভিকটিমকে তার নিজ বাড়ি খুলনা থেকে তুলে নিয়ে আসে। যশোর বড়বাজারে অবস্থিত রফিকুল ইসলাম চৌধুরীর (মুল্লুক চাঁন) চাউলের গোডাউনে আটকে রাখে। বায়েজিদকে গোডাউনে আটক রেখে প্রধান আসামি রফিকুল ইসলাম চৌধুরী মুল্লুক চাঁন (৫৬) সঞ্জয় চৌধুরী (৫২) শহিদুল ইসলাম (৪৫) ও গ্রেফতারকৃত আসামিসহ অন্যান্য আসামিরা মিলে শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করে।

এর আগে ২৬ মার্চ পুলিশ বায়েজিদ হত্যা মামলার আর এক আসামি মোস্তাফিজুর রহমানকে আটক করে। সে আদালতে বায়েজিদ হত্যা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ন তথ্য দেয়। মামলা তদন্তের স্বার্থে পুলিশ তথ্যগুলি পরে প্রকাশ করবে। এরআগে বুধবার মোস্তাফিজুর রহমান যশোর জুডিশিয়াল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে একই তথ্য দেন। এনিয়ে এজাহারভুক্ত ৯ আসামির মধ্যে ৩ জনকে গ্রেফতার করা হলো। তবে প্রধান দুই আসামি মুল্লুক-সঞ্জয় রয়েছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তাদেরকে এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলারিক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। গ্রেফতারকৃতরা হলেন-যশোর সদরের লেবুতলা গ্রামের খাইরুল ইসলামের ছেলে আব্দুর রহমান রাজন, ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীর নবীননগরের আবুল হাশেনের ছেলে রাজু আহম্মেদ ওরফে রাজ ও মনিরামপুরের লাউড়ি গ্রামের নুরুল হকের ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান খোকা। তবে চাঞ্চল্য এই হত্যাকাণ্ডের পরও ডিবি বা পিবিআই-এর কোন তৎপরতা দেখা যায়নি। ইতিপূর্বে চাঞ্চল্যকর কোন হত্যকাণ্ড বা বড় কোন অপরাধের ঘটনা ঘটলে ডিবি পুলিশ ও পিবিআই ছায়া তদন্ত করতো। এই মামলায় তেমন কোন লক্ষণ দেখা যায়নি। ফলে নানা প্রশ্ন ঘুরে ফিরছে মুখে মুখে। বিশেষ করে প্রকৌশলী বায়েজীদ হাসানকে খুলনা থেকে ধরে আনার সময় সঞ্জয় চৌধুরীর এবং তাকে হত্যাকাণ্ডের সময় মুল্লুক চাঁদ ও সঞ্জয় চৌধুরীর মোবাইলের সিডিআর নিলে তাদের লোকেশন সনাক্ত করা সম্ভব ছিল। খুলতো অনেক রহস্যের জট। কিন্তু সেটি করা হয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একইভাবে সিসিটিভিরফুটেজের ডিভিআর কোথায়? এ ক্ষেত্রেও ডিবির কোন তৎপরতা দেখা যায়নি। চারদিন পরে মহল বিশেষ প্রচার করার চেষ্টা করছে সিসিটিভি অকেজো ছিল। যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে জানা গেছে। এসব ক্ষেত্রে ডিবি পুলিশ কেন নিরব সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। মূল কিলার রফিকুল ইসলাম চৌধুরী মুল্লুক চাঁন (৫৬) এবং তার সহদর সঞ্জয় চৌধুরী (৫২)-কে রক্ষা করতে মহল বিশেষ কাজ করছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যেখানে ডিবি পুলিশ একদিনের মধ্যে সুমন হত্যাকাণ্ডের তথ্য উদঘাটন করার কৃতীত্ব দেখিয়েছে। সেখানে থানা থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে ঘটে যাওয়া এই হত্যাকাণ্ডে কেন ডিবি পুলিশ নীরব? যশোর কোতয়ালী পুলিশ এই মামলায় তেমন কোন সাফল্য দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। একজনকে আটক করে জবানবন্দি আদায় করেছে যা বাস্তব বিবর্জিত। তবে ডিবি পুলিশ ঘরে বসে থাকলেও সাফল্য দেখিযেছে র‌্যাব-৬ যশোরের দায়িত্বশীলরা। তারা ঢাকা থেকে ইতিমধ্যে দুইজনকে আটক করেছে।
এদিকে, খুলনা সিটি করপোরেশনের ২৫ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আলী আকবর টিপু বলেন, ২৪ মার্চ দুপুরে মুল্লুক-সঞ্জয়ের লোক নামে পরিচিত শহিদুলসহ ৪/৫ জন সোনাডাঙ্গার বাসিন্দা ও মেধাবী প্রকৌশলী বায়োজিদ হাসানকে বাড়ি থেকে গাড়িতে তুলে নেয় ১৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও শ্রমিক নেতা জাকির হোসেন বিপ্লবের অফিসে। বিপ্লব আমাকে ফোন করে বিষয়টি অবগত করেন। এক পর্যায়ে দুজনই লাউড স্পিকার অন করে মিমাংসার আলোচনা শুরু করি। এ সময় বায়োজিদ পরিবারের লোকজন আমার অফিসে ছিলেন। অন্যদিকে বিপ্লবের অফিসে ছিলেন মুল্লুক-সঞ্জয়ের লোকজন। আমাদের আলোচনা উভয়পাশে অবস্থান করা ব্যক্তিরা শুনছিলেন। আমি বলেছিলাম বায়োজিদের গায়ে যেন হাত না পড়ে। ও খুব মেধাবী ও ভাল ছেলে। আলোচনার এক পর্যায়ে আমরা দুই কাউন্সিলর ইফতার করতে বাড়িতে যাই। ফিরে এসে ফের আলোচনার মাধ্যমে মিমাংসার কথা ছিল কিন্তু অফিসে কাউন্সিলর বিপ্লবকে ফোন করে জানতে পারি তারা কেউ নেই। অভিযোগ রয়েছে-বিপ্লবের অফিসে থাকা কিছু শ্রমিক বায়োজিদকে অপহরণের কাজে সহায়তা করেন। কাউন্সিলর আলী আকবর টিপু বলেন, কাউন্সিলর বিপ্লব আমাকে আশ্বস্ত করেছিলেন পরদিন ২৫ মার্চ বায়োজিদতে তারা যশোর থেকে খুলনাতে আনবে। দুই কাউন্সিলর উভয়পক্ষের কথা শুনে নিস্পত্তি করবো কিন্তু পরে জানতে পারি মুল্লুক চাঁদ ও সঞ্জয় এবং তাদের টর্চার সেলের লোকজন বায়োজিদকে গাড়ির ভেতর মারতে মারতে যশোরের মনিরামপুরে ও পরে কেশবপুর ঘুরে যশোর কাঁশারীপট্টির একটি চালের আড়তে নিয়ে মারপিট করে। বায়োজিদের বৃদ্ধা মা দিলরুবা বেগমকেও তারা অশ্লীল ভাষায় গালি গলাজ করে এবং সাফ জানিয়ে দেয় টাকা অথবা দলিল নিয়ে যশোরে আই…। অন্যত্থায় ছেলের লাশ যাবে। পরে বায়োজিদের মা ও স্ত্রীসহ পরিবারের লোকজন কান্না করতে থাকেন। এক পর্যায়ে আমি সঞ্জয়কে ফোন করে অনুরোধ করি দয়া করে সকালে খুলনাতে আসেন। আমি টাকা আদায়ে সহায়তা করবো কিন্তু সঞ্জয় কোনো কথায় কর্নপাত করেনি। রাত সাড়ে ৩টার সময় যশোর কোতয়ালি থানার ওসিকে ফোন করি। তখন ওসি জানান, রফিকুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে মুল্লুক চাঁদের চালের আড়তে এক যুবকের লাশ পড়ে আছে। তিনি বায়োজিদের পরিবারকে বিষয়টি জানিয়ে তাদের যশোরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন-ওরা আমার ও বিপ্লবের অনুরোধ রাখেনি। লাশ করেই পাঠালো মেধাবী প্রকৌশলী বায়োজিদকে। প্রসঙ্গত, ২৪ মার্চ রাতে যশোর কাঁশারিপট্টিতে মুল্লুক চাঁদের চালের আড়তে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন প্রকৌশলী বায়োজিদ হাসান। এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হওয়া ৩ আসামিই স্বীকার করেছেন- মুল্লুক-সঞ্জয়ের নির্দেশ ও উপস্থিতিতে হত্যকাণ্ডটি ঘটেছে। তারা হত্যার দায় স্বীকার করে বলেন-হত্যাকাণ্ডে চৌধুরী টর্চার সেলের আমরা ৩ জন ছাড়াও সাব ঠিকাদার শহিদুল ইসলাম, মহব্বত আলী মন্টু, শাহ আলম ও জসিম মোল্লাসহ আরও ৫ থেকে ৬ জন অংশ নেন। এদের মধ্যে আজ পর্যন্ত ৩ জনকে গ্রেফতার করলো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। লৌমহর্ষক ও বর্বোরোচিত নৃশংস এই হত্যকাণ্ডের শিকার বায়োজিদ হাসান চৌধুরী কনস্ট্রাকশনের ঢাকা অফিসে চাকরি করতেন। তিনি ছিলেন ও সৎ প্রকৌশলী বায়োজিদ হাসান। সেখানে নির্মাণাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের সাব ঠিকাদার শহিদুল ইসলাম নয়-ছয় করে টাকা আত্মসাতের জন্য তার ওপর চাপ সৃষ্টি করে আসছিলেন কিন্তু বায়োজিদ রাজী না হওয়ায় ক্রমাগতভাবে চাপ বাড়তে থাকে। বায়োজিদের স্ত্রী তাকিয়া তুজ সাদিয়া স্বর্ণলতা নিউজকে বলেন-ইঞ্জিনিয়ারের দায়িত্ব কন্স্ট্রাকশনের কাজ ঠিক-ঠাক হচ্ছে কি-না, তা দেখা। কিন্তু সাব ঠিকাদার শহিদুল চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি পরিচ্ছন্ন ভাষায় হুমকি দিয়ে আসছিলেন। যেকারণে বায়োজিত মৃত্যু ভয়ের মধ্যে পড়েন। তার সন্দেহ হয়-নির্মাণাধীন ভবনে হত্যা করে দুর্ঘটনা বলে চাউর করতে পারে শহিদুল। এ সন্দেহ থেকে আমরা স্বামী-স্ত্রী খুলনার বাড়িতে চলে আসি। এ সময় শহিদুলের ধারণা জন্মে বিষয়টি বায়োজিদ ফাঁস করে দিতে পারে। যেকারণে আমার স্বামীর বিরুদ্ধে চৌধুরী কনস্ট্রাকশনের সত্বাধিকারী মুল্লুক চাঁদ ও তার ভাই সঞ্জয়ের কাছে টাকা চুরির অভিযোগ দেন শহিদুল। শেষ পর্যন্ত দুর্নীতিবাজ শহিদুলের কারণেই বায়োজিদের প্রাণ গেল। তিনি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্বামী হত্যার বিচার দাবি করেন। এদিকে ঢাকায় রাজু ও রাজনকে গ্রেফতার করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন যশোর র‌্যাব-৬ এর কোম্পানি কমাণ্ডার মেজর মোহাম্মাদ সাকিব হোসেন।