রোগীর পাশাপাশি গরু-কুকুরের অবাধ বিচরণ হাসপাতাল জুড়ে

0
17

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি
তিনবার দেশসেরার খ্যাতি পাওয়া ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে। হাসপাতালে গরু ও কুকুরের অবাধ বিচরণ দেখে মনে হবে মানুষের সঙ্গে এরাও চিকিৎসা নিতে এসেছে। হাসপাতালের সেবার মানের পাশাপাশি চিকিৎসক, নার্স এবং স্টাফদের আচরণ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন রোগী এবং তাদের স্বজনরা। তবে এসব মানতে নারাজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
রোববার (২৮ এপ্রিল) বিকেলে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গরু-কুকুরের অবাধ বিচরণের কিছু ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ওই ছবিগুলোতে দেখা যায় যায়, হাসপাতালে রোগীর সঙ্গে কুকুর শুয়ে আছে। দেখলে মনে হবে যেন কুকুরের পাল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছে। অপর একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, গরুও রোগীর সঙ্গে হেঁটে হাসপাতালে ঢুকছে।
আব্দুল্লাহ আল আমিন নামে একজন ফেসবুকে ছবিগুলো পোস্ট করে লিখেছেন, ‘মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী, ময়মনসিংহ-৪ সদর আসনের সংসদ সদস্য, বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এশিয়া মহাদেশের মাঝে নাম করা উল্লেখযোগ্য একটি প্রতিষ্ঠান, আজ এই হাল কেন? যেখানে টেন্ডার নিয়ে মারামারি হয়, পুলিশ পাহারা দিতে হয়। হাসপাতালের নিরাপত্তায় কতজন সরকারি বেসরকারি (আউটসোর্সিং) নিরাপত্তা রক্ষী রয়েছে! অভ্যন্তরে টয়লেটগুলোর কী হাল সরেজমিন পরিদর্শন করুন।’
সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম তরফদারের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করা ছবিতে দেখায় যায়, রোগীর পাশে কুকুর শুয়ে আছে। এমন ছবি পোস্ট করে তিনি লিখেছেন, ‘হায়রে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দৃশ্য।’
এক হাজার শয্যার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বৃহত্তর ময়মনসিংহের ছয় জেলার মানুষ ছাড়াও কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ এবং গাজীপুর থেকে রোগীরা সেবা নিয়ে থাকেন। প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার রোগী ভর্তি থাকেন এখানে। এছাড়াও আউটডোরে চার থেকে সাড়ে চার হাজার রোগী চিকিৎসাসেবা নেন। প্রতিদিন গড়ে প্রায় আট হাজার রোগীর চাপ সামলিয়ে সেবার মান নিশ্চিত করে বিগত পরিচালনা প্রশাসনের নেতৃত্বে ২০১৮, ১৯ এবং ২০২০ সালে ‘হেলথ মিনিস্টারস’ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছিল এই প্রতিষ্ঠানটি। তবে সম্প্রতি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নানা অব্যবস্থাপনায় ক্ষুব্ধ রোগী, তাদের স্বজন এবং নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ।
সম্প্রতি লক্ষ্য করা যায়, নোংরা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে মেঝে এবং বারান্দায় গাদাগাদি করে শুয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে রোগীদের। দেড়-দুই বছর আগে নিয়মিত ওষুধ পাওয়া গেলেও এখন প্রকট সংকট দেখানো হচ্ছে। পরীক্ষা-নীরিক্ষাতেও ভুলের অভিযোগ। আবার অনেক চিকিৎসক বাহিরে তাদের পছন্দের প্রাইভেট হাসপাতালে বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন রোগীদের।
হার্টের সমস্যা নিয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৭১ শয্যা কার্ডিওলজি বিভাগে ভর্তি হন জেলার হালুয়াঘাটের মোশারফ হোসেন। শয্যা না পেয়ে বারান্দায় সেবা নিচ্ছেন তিনি। ভর্তি হওয়ার পরপরই কিছু পরীক্ষা-নীরিক্ষা করার সুযোগ পেলেও ইকো বা ইকোকার্ডিওগ্রাফি পরীক্ষার সময় বেঁধে দেওয়া হয় দুই মাস। বাধ্য হয়ে তিনি ইকোসহ বেশ কয়েকটি পরীক্ষা বাহিরে করান।
মোশারফ হোসেন বলেন, আমি হার্টের রোগী হওয়ায় অন্যান্য পরীক্ষার সঙ্গে ডাক্তার বলেছে ইকো পরীক্ষা করাতে। কিন্তু তারা পরীক্ষার জন্য সিরিয়াল দিয়েছে দুই মাস পর। বাধ্য হয়ে তা বাহিরে করিয়েছি। মেশিন নষ্ট থাকার কারণে অনেক পরীক্ষা তাদের এখানে হচ্ছে না। তাই ডাক্তাররা অন্য ক্লিনিকে করার পরামর্শ দিচ্ছেন। আমরা গরীব বলেই এই হাসপাতালে সেবা নিতে আসি; কিন্তু সেখানে এসে ভোগান্তির পাশাপাশি ফতুর হচ্ছি।
একই অবস্থা আট মাস আগে ভর্তি হওয়া অনতি পালের। তাকে ঢাকায় গিয়ে ইকো এবং এনজিওগ্রাম করার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
আক্ষেপ করে অনতি পাল বলেন, আমার যদি ঢাকায় গিয়েই চিকিৎসা করার মতো অবস্থা থাকতো তাহলে কি এখানে এতদিন থাকতাম। তাদের পরামর্শে বাহিরের ক্লিনিক থেকে অনেক পরীক্ষা করিয়েছি। এখন হাত খালি, ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচও জোগাড় করতে পারছি না। মনে হচ্ছে মরলেই বাঁচি।
একই ওয়ার্ডে মাকে ভর্তি করিয়েছেন তারাকান্দার যুবক রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ওয়ার্ডে ডাক্তার নার্স পাওয়া গেলেও ওয়াশরুমের অবস্থা একেবারেই খারাপ। ভালো মানুষও সেখানে গিয়ে অসুস্থ হচ্ছে। দেশসেরা হাসপাতালের এই অবস্থা ভালো লক্ষণ নয়।
প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাড়ে তিনশো থেকে চারশো রোগীর পরীক্ষা-নীরিক্ষা করার কারণে তিনটি ইকো মেশিনের মধ্যে দুটিই অকেজো হওয়ায় পরীক্ষায় সময় লাগছে বলে জানিয়েছেন কার্ডিওলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. গোবিন্দ কান্তি পাল। তিনি বলেন, বেড ৭১টি, কিন্তু রোগী ভর্তি থাকে প্রায় সাড়ে তিনশো থেকে চারশো। তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আত্মীয়-স্বজন আসে তিন থেকে চারজন করে। তাহলে ওয়ার্ডের পরিবেশটা কেমন হবে আপনারাই বলেন? সেবার মান নিশ্চিত করতে অ্যাটেনডেন্স কার্ড করা হয়েছে। একজন রোগীর সঙ্গে সর্বোচ্চ দুইজনকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আমরা ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছি।
অকেজো ইকো মেশিন মেরামত এবং নতুন মেশিনের চাহিদার কথা জানিয়ে ২০২১ সাল থেকে গত তিন বছরে কার্ডিওলজি বিভাগ থেকে সাত দফা হাসপাতালের পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
গাইনি ওয়ার্ডে স্ত্রীকে ভর্তি করিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, পরিচালক নাসির উদ্দিনের সময়ে হাসপাতালে একটা শৃঙ্খলা ছিল। এখন তার কিছুই নেই। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের মধ্যে রোগীরা সেবা নিচ্ছে। নার্স এবং চিকিৎসকরাও আন্তরিক না। তারা রোগী এবং তাদের স্বজনদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করে। তিনটির মধ্যে একটি ওষুধ হাসপাতালে পাওয়া গেছে, বাকি দুটি বাহির থেকে কিনেছি। বছরের শুরুতে যদি এমন অবস্থা হয় তাহলে শেষে কী হতে পারে আপনারাই বলুন?
৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি খায়রুল ইসলাম নামে এক রোগী বলেন, হাসপাতালটিতে রোগীর অতিরিক্ত চাপের কারণে মানুষ মেঝে এবং বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছে। কিন্তু সেখানে অপরিচ্ছন্ন। ভেতরে অনেকগুলো গেট অতিক্রম করে কুকুর এবং গরু প্রবেশ করছে। তাহলে দারোয়ান রেখে লাভ কী?
হাসপাতালের নানা অসঙ্গতির বিষয় জানার পাশাপাশি রোগীদের ভোগান্তি নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমান শান্তর নির্দেশে জরুরি বিভাগে ‘অনুভূতির বাক্স’ স্থাপন করেছে মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগ।
পরপর তিনবার দেশসেরার খ্যাতি অর্জন করা হাসপাতালের এমন চিত্রে ক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দরা। জনউদ্যোগ ময়মনসিংহের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম চুন্নু বলেন, স্থানীয় সংসদের অনুভূতির বাক্স স্থাপনকে অন্তত সম্মান দেখিয়ে হলেও রোগীদের প্রতি চিকিৎসকদের আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। আমরা পুরস্কার না পেলেও চাই রোগীরা যেন তৃপ্তি নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারে।
এদিকে অব্যবস্থাপনার বিষয়ে প্রশ্ন করায় রেগে যান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ মাইনউদ্দিন খান। তিনি বলেন, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও যে আমরা সেবা দিয়ে যাচ্ছি সেটাতো বলেন না। সেবার মান যদি খারাপ হতো তাহলে কি ১ হাজার শয্যার হাসপাতালে ৪ হাজার রোগী ভর্তি থাকতো।
অবাধে কুকুর এবং গরুর বিচরণের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, কার্ডিওলজি বিভাগের দুর্ভোগ নিরসনে পরবর্তী অর্থবছরে নতুন ইকো মেশিন কেনা হবে। এছাড়াও সেবার মান নিশ্চিতে অন্যান্য সমস্যা নিরসনে কাজ হচ্ছে।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. জাকিউল ইসলাম বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিগুলো নজরে এসেছে। সিটি করপোরেশনে বলা হয়েছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে।
রোগীদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার থেকে যে পরিমাণ ওষুধ আসে, সব ওষুধই আমরা রোগীদের দিয়ে দিই।