দলীয় নির্দেশ অমান্যের হিড়িক

0
17

মোস্তফা হোসেইন
লোম বাছতে গিয়ে কম্বল উজাড়- এমনটাই মনে হতে পারে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ায় বিএনপির ৭৩ নেতা-নেত্রীকে বহিষ্কারের সংবাদ দেখে। বহিষ্কার হওয়া নেতাদের মধ্যে ২৮ জন উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী, ২৪ জন ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ও ২১জন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী। গত সংসদীয় নির্বাচনেও বহিষ্কার হয়েছেন অনেক নেতা-কর্মী। হয়েছেন সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও। উপজেলা নির্বাচনের পর ঘনিয়ে আসবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। সেটিও হবে বর্তমান সরকারের মেয়াদকালেই। ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনেই অংশ নেবে না। বলা প্রয়োজন যে কোনো বড় দলের বৃহৎ একটি অংশ ইউনিয়ন পর্যায়ের। তাহলে একবারে তৃণমূল পর্যায়ের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও কি চলবে একই প্রক্রিয়া?
বিএনপি আগেই তাদের সিদ্ধান্তের কথা গণমাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছিলো। সুতরাং যারা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন তারা জেনেশুনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে, ২০১৮ সংসদীয় নির্বাচনে বিএনপির বিদ্রোহী নেতাদের চেয়ে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে সংখ্যাটা বেশি। দলীয় নির্দেশকে অমান্য করে এই নেতা-নেত্রীদের উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কারণ বিশ্লেষণ হতে পারে। তারা কেন জেনেশুনেও এই নির্দেশ অমান্য করলো। অন্যদিকে দল থেকে যেখানে বলা হচ্ছে-আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হবে না সেখানে কোন ভরসায় তারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন? আর বহিষ্কারাদেশের পরবর্তী রাজনৈতিক পরিচিতিও যে অস্পষ্টতায় আচ্ছন্ন থেকে যাচ্ছে তাও বলার অপেক্ষা রাখে না।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকারের ক্ষমতায় থাকা না থাকার পরিস্থিতি তৈরি হয় না কিন্তু এই নির্বাচনে দলীয় শক্তি সৃষ্টি এবং জনপ্রিয়তা যাচাই হয় এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না। আওয়ামী লীগের এমপি মন্ত্রীদের কারণ দর্শানো পর্যন্ত সাংগঠনিক উদ্যোগ হয়তো নেয়া হতেও পারে। তারপরও তৃণমূল পর্যায়ে এর কুপ্রভাব পড়তে পারে। এই বিভক্তিকে জোড়া লাগানোর কাজে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দক্ষতার ওপর নির্ভর করবে আগামীতে তাদের রাজনীতি। অন্যদিকে বিএনপির বর্জন রাজনীতি তাদের ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক শক্তিতে প্রাণ ফিরে আসবে কিনা তাও দেখার বিষয়।
উপজেলা নির্বাচন বর্জনের দলীয় সিদ্ধান্তের যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে- এতে করে আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বৈধতা পাবে। বিএনপির নির্বাচন বর্জন আওয়ামী লীগের নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য কতটা করতে পেরেছে তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। সংসদীয় নির্বাচন বর্জন করার মধ্য দিয়ে বিএনপি কি তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে প্রমাণ করতে পেরেছে? বিশ্বসম্প্রদায় বিগত সংসদীয় নির্বাচনকে গ্রহণ করেছে, বাংলাদেশে গত নির্বাচনের পর বিজয়ী দল সরকারও গঠন করতে পেরেছে। বিশ্বসম্প্রদায়ও বর্তমান সরকারকে স্বীকৃতিও প্রদান করেছে।
স্থানীয় নেতৃবৃন্দ দেখেছেন আসলে আওয়ামী লীগকে কাবু করতে গিয়ে দল যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে তাতে আওয়ামী লীগের বিজয়কে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। বরং বিএনপিই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। বিএনপির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যদি তারা উপজেলা নির্বাচনেও বসে থাকে তাহলে তালে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বই প্রশ্নের মুখে পড়বে।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনও বর্জন করেছে বিএনপি। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে মেয়র নির্বাচনে তারা কাউকে মনোনয়ন না দিলেও বিএনপির সাবেক দুই নেতা যথাক্রমে নিজাম উদ্দিন কায়সার ও সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।তারাও যথারীতি দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। ওখানকার নির্বাচনে দুই প্রার্থীর সঙ্গে বিশাল সংখ্যক কর্মী নির্বাচনী প্রচারণায় যোগ দিয়েছেন। তবে দলের উল্লেখযোগ্য একটি অংশও দিলীয় নির্দেশনা মেনে নির্বাচনী কার্যক্রম থেকে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন। ফলে কর্মীদের মধ্যে এই মুহূর্তে কুমিল্লায় ৩টি ভাগ হয়ে গেছে।
বর্জনকারীরা কি সাক্কু এবং কায়সারের কর্মীদের আর ওইভাবে গ্রহণ করবে? তারা চিহ্নিত হয়ে আছেন দলের ঘোষণা অনুযায়ী বেইমান হিসেবে। তার মানে হচ্ছে, কুমিল্লায় এই মুহূর্তে বিএনপি তিনটি ভাগে বিভক্ত। যার দুটি ভাগই আর বিএনপিতে নেই বলেই গণ্য হচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই কুমিল্লায় বিএনপি আগের তুলনায় শক্তি হারিয়েছে ব্যাপকভাবে। অথচ মনিরুল হক সাক্কু দুই দুইবার মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রার্থীকে পরাজিত করে। আর আওয়ামী লীগের শাসনামলেই মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছিলেন দাপটের সঙ্গে। মেয়রের ক্ষমতায় থাকাকালে তার দলীয় নেতাকর্মীরা তার সান্নিধ্য পেয়েছে,ক্ষমতার সুযোগসুবিধা পাওয়ার সুবাদে তার প্রতি আনুগত্যও ছিলো। সিটি নির্বাচনেও যাদের তার পক্ষ হয়ে কাজ করতে দেখা গেছে। অর্থাৎ কুমিল্লা সিটি করপোরেশন উপনির্বাচন বর্জন করে বিএনপি তার কর্মীদের বড় একটি অংশকে হারিয়েছে।
স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরি হয় মূলত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। প্রতিটি নির্বাচনই যদি বর্জনের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে তাহলে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের রাজনৈতিক উত্থান যেমন বাধাগ্রস্থ হয় তেমনি স্থানীয় পর্যায়ে অন্য দলগুলোর সঙ্গেও তাদের অবস্থান শূন্যে গিয়ে ঠেকে। এমন অবস্থায় কেন্দ্রীয় নির্দেশ যাই থাকুক না কেন তারা নিজেদের প্রয়োজনে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কোনো না কোনোভবে অংশগ্রহণ করে।
আওয়ামী লীগ মনোনয়ন প্রথা স্থগিত করেছে উপজেলা নির্বাচনে। যে কারণে তাদের নেতা-কর্মীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ উন্মুক্ত হয়ে গেছে। এতে করে আওয়ামী লীগের দলীয় সুবিধা ও অসুবিধা দুটোই আছে। এতে করে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় তৃণমূলে নেতৃত্বের পরীক্ষা হয়ে যায়। আগামীতে সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে মনোনয়নদানে প্রার্থী বাছাই করতে সহজ হবে।
সাংগঠনিকভাবেও নেতা বাছাইয়ে সহযোগিতা করবে। অবশ্য বিপরীত দিকও আছে এই উন্মুক্ত নির্বাচন মাধ্যমে। প্রতিটি উপজেলায় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে দলীয় কোন্দল। একই নির্বাচনী এলাকায় একাধিক দলীয় প্রার্থী হওয়ায় প্রার্থীদের সমর্থনে কর্মীরাও বিভক্ত হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্থানে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সূত্রপাতও হয়েছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে।
এই কোন্দল থামাতে গিয়ে কেন্দ্রকেও হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। নির্বাচন যাতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রভাবমুক্ত হয় সেইজন্য আওয়ামী লীগ থেকে বলা হয়েছে কোনো এমপি মন্ত্রী উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। কোনো প্রার্থীর পক্ষে কিংবা বিপক্ষে কাজও করতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, এমপি মন্ত্রীদের কেউ কেউ উপজেলা নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীদের পক্ষে মাঠে নেমে গেছেন। দলীয় নির্দেশ আছে, কোনো এমপি মন্ত্রীর স্বজনরা অংশ নিতে পারবে না। এই নির্দেশও শতভাগ মান্য হচ্ছে না।
এই নির্দেশের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিও আছে। ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করতে এবং কোন্দল কমিয়ে আনার জন্য এই নির্দেশ দেওয়া হলেও বাস্তবতা হচ্ছে-বাবা ভাই কিংবা স্বামী এমপি মন্ত্রী হলে কি নিকটজনের রাজনীতি অবৈধ হয়? তারা কি জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাব পাওয়ার আগেই তাই এমপি-মন্ত্রীদের স্বজনদের অনেকেই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকারের ক্ষমতায় থাকা না থাকার পরিস্থিতি তৈরি হয় না কিন্তু এই নির্বাচনে দলীয় শক্তি সৃষ্টি এবং জনপ্রিয়তা যাচাই হয় এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না। আওয়ামী লীগের এমপি মন্ত্রীদের কারণ দর্শানো পর্যন্ত সাংগঠনিক উদ্যোগ হয়তো নেয়া হতেও পারে। তারপরও তৃণমূল পর্যায়ে এর কুপ্রভাব পড়তে পারে। এই বিভক্তিকে জোড়া লাগানোর কাজে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দক্ষতার ওপর নির্ভর করবে আগামীতে তাদের রাজনীতি। অন্যদিকে বিএনপির বর্জন রাজনীতি তাদের ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক শক্তিতে প্রাণ ফিরে আসবে কিনা তাও দেখার বিষয়।
লেখক: সাংবাদিক,শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।