২২ বছরে ২৫ দফায় রহস্যজনক আগুনে পুড়েছে সুন্দরবন: হেলিকপ্টার দিয়ে পানি ছিটিয়েও পুরোপুরী নিয়ন্ত্রণে আসেনি আগুন

0
12

কামরুজ্জামান মুকুল/ এনামুল কবির, বাগেরহাট
অগ্নিকাণ্ডের ২৪ ঘণ্টা পার হলেও বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের আমরবুনিয়া বনের আগুন পুরোপুরি নেভানো যায়নি। নৌ, কোস্ট গার্ড, ফায়ার সার্ভিস ও বনরক্ষীদের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণের চেস্টা করছে বলে জানিয়েছে বনবিভাগ। এদিকে বাংলাদেশ নৌবাহিনী হেলিকপ্টার দিয়ে পানি ছিটিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টাও করেছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিগত ২২ বছরে সুন্দরবনে আগুন লেগেছে ২৫ বার। সর্বশেষ আগুন লাগে গত শনিবার দুপুরে। বনবিভাগ জানায়, রোববার সকাল থেকে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট পানি ছিটিয়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয় নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড। এ ছাড়া স্থানীয় গ্রামবাসীও আগুন নেভাতে বনবিভাগকে সহযোগিতা করছে। দুপুরে বনের আগুন নেভাতে উপর থেকে হেলিকপ্টার দিয়ে পানি ছিটানো হয়। এদিকে বিকালে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা দীপংকর বর বলেন, বেলা ১টার দিকে বন বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে সেখানে এখনও কাজ চলছে। মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আগুন গাছের উপরে বা ডালপালায় বিস্তৃত হয়নি, শুধু মাটির উপরে বিক্ষিপ্তভাবে বিস্তৃত হয়েছে। সেখানে আগামী কয়েকদিন অগ্নি নির্বাপণসংশ্লিষ্ট কার্যক্রম চালু রাখা হবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়। তবে আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখতে ফায়ার লাইন কেটে (মাটি কেটে বিচ্ছিন্ন) আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে বনবিভাগ। প্রায় চার একর এলাকায় আগুনের বিস্তৃতি ঘটেছে। তবে আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানাতে পারেনি বনবিভাগের কর্মকর্তারা। দুপুরে বনবিভাগের খুলনা কার্যালয়ের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো, বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহা. খালিদ হোসেনসহ স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
এর আগে শনিবার দুপুরে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া এলাকায় আগুন লাগে। পরে বনবিভাগ ও স্থানীয় গ্রামবাসী পানি ছিটিয়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। মোরেলগঞ্জ উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম বলেন, “আমরা আগুনের খবর পেয়ে বনের ভেতরে আসি। এসে দেখি অন্তত ৫০টি স্থানে আগুন জ্বলছে। আগুনের বিস্তৃতি ব্যাপক এলাকাজুড়ে। এলাকার লোকজন এসে কলস বালতিতে করে পানি এনে আগুন নিভাই। আমুরবুনিয়া গ্রামের প্রায় আড়াইশ নারী-পুরুষ আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয়। ‘প্রায় দুই কিলোমিটার দূর থেকে কলস বালতি ও হাঁড়িতে করে পানি নিয়ে আগুন নেভায়। আগুন এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বড় আগুন আর দেখা যাচ্ছে না। কিছু কিছু এলাকায় ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। যেখানেই ধোঁয়া দেখছি সেখানেই পানি ছিটানো হচ্ছে।’ বনবিভাগের খুলনা কার্যালয়ের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো সাংবাদিকদের বলেন, “বনে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণ রাখতে প্রথম কাজ হলো, ফায়ার লাইন কেটে আগুনকে নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে রাখা। সকাল থেকে সেই কাজটি করা হয়। পরে গণ্ডির ভেতরে যেসব স্থানে আগুন দেখছি সেটি নিভাচ্ছি। ‘বনের লাগা আগুন চার একরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছি। আগুন নেভানোর কাজে ফায়ার সার্ভিস, নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, গ্রামবাসী সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। দুপুরে বনের আগুন নেভাতে উপর থেকে হেলিকপ্টার দিয়ে পানি ছিটানো হয়। সুতরাং বলা যায়, এখন আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘তবে বনের ভেতরে প্রচুর পরিমাণে শুকনা ঝরাপাতা পড়ে রয়েছে। আগুন নিভলেও ২/৩ ঘণ্টা পরে শুকনা পাতার ভেতরে আগুন আবার জ্বলে উঠতে পারে। এখন সেভাবে আগুনের শিখা নেই, তবে কিছু কিছু স্থানে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে।’ আগুন লাগা এলাকাটি আগামী দুই থেকে তিনদিন পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে বলে জানান এই বন সংরক্ষক। এদিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে বন বিভাগের বরাতে জানিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। রোববার বিকালে মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ”আগুন লাগার স্থানের চারদিকে প্রায় পাঁচ একর জায়গাজুড়ে ফায়ার লাইন কেটে আগুন নেভানোর কাজ চলছে জানিয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয় বলছে, ‘আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও যেহেতু আগুন মাটির নিচ দিয়ে গাছের শিকড়ের মধ্যে দিয়ে বিস্তৃতি লাভ করছে। তাই সতর্কতার সাথে আগুন নেভাতে হচ্ছে।’ আগামী কয়েকদিন এখানে অগ্নি নির্বাপণসংশ্লিষ্ট কার্যক্রম চালু রাখা হবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।
‘কেননা ফরেস্ট ফায়ার আপাতত নিভে গেছে বা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে বলে মনে হলেও আবার যে কোনো সময় এটি নতুনভাবে সৃষ্টি ও বিস্তৃতি লাভ করতে পারে।’ ঘটনাস্থলে বন বিভাগের পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি ইউনিট, নৌবাহিনী, পুলিশ, জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, সিপিজি, স্বেচ্ছাসেবক ও স্থানীয় জনগণ অগ্নি নির্বাপণে সহায়তা করছেন। এছাড়া বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারও অগ্নি নির্বাপণে উপর থেকে পানি ছিটিয়ে সহায়তা করেছে। বিজ্ঞপ্তিতে পরিবেশ মন্ত্রণালয় বলেছে, শনিবার আগুন লাগার পরপরই বন বিভাগের কর্মীরা স্থানীয় কমিউনিটি পেট্রোলিং গ্রুপ, ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম এবং স্থানীয় জনগণের সহায়তায় আগুন লাগার চারপাশে ফায়ার লাইন কাটার কাজ শুরু করেন। কিন্তু সেই সময়ে ভাটার কারণে খালে কোন পানি না থাকায় আগুনে পানি দেওয়া সম্ভব হয়নি। ‘রাতেই বন বিভাগের নিজস্ব ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্ট ও পানি দেয়ার মেশিন এনে সেটি প্রস্তুত করে পাইপ লাগিয়ে সেট করে রাখা হয়। রোববার ভোর থেকেই বন বিভাগের কর্মীরা ফায়ার সার্ভিস, স্থানীয় জনগণ, সিপিজি, সিএমসির লোকদের নিয়ে আগুন লাগার স্থানে চারদিকে ফায়ার লাইন কাটার পাশাপাশি পানি দিয়ে আগুন নেভানোর কাজ পুরোদমে শুরু করেন।’ প্রসঙ্গত, সুন্দরবন বিগত ২২ বছরে অন্তত ২৫ বার আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়েছে। সর্বশেষ শনিবার (০৪মে) বিকাল পৌনে তিন টায় সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের আমরবুনিয়া এলাকায় আগুন লাগে। রোববার (০৫ মে) সকাল ৮ টায় ফায়ার সার্ভিসের ৩টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেছে। পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন, বনরক্ষী ও স্থানীয় বাসিন্দারা অংশগ্রহণ করেছে বনরক্ষার কাজে।