অর্থবছর ২০২৪-২৫ শুরু হচ্ছে বাজেট প্রণয়নের কাজ, অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে নতুন কৌশল

0
19

প্রতিদিনের ডেস্ক
অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ, জ্বালানি সরবারহ নিশ্চিত করাসহ নানাবিধ চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। নতুন বছরের জুনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা হবে। বরাবরের মতোই বছরের শুরুতে বাজটে প্রণয়নে কর্মপরিকল্পনা, বাজেট সমীক্ষার কাজ শুরু করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
তবে এখনো ঠিক হয়নি বাজেট প্রণয়নে স্টেকহোল্ডার বা বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে বৈঠকের দিনক্ষণ ও বাজেট সমন্বয়ক চূড়ান্তের কাজ।
রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, নতুন বাজেটে সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে সুপারিশ ও আবেদন শুরু করেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন। আর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় আসা সরকারকে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সুচিন্তিত ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতির সংকট মোকাবিলায় নতুন কৌশল বাজেটে প্রাধান্য পাবে।
গতবছরের জুনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট পাস হয়। সর্বজনীন পেনশন, সামাজিক খাতে বরাদ্দ বাড়ানোসহ বেশ কিছু ইতিবাচক বিষয় ছিল বাজেটে। তবে কালো টাকা ও পাচার হওয়া অর্থ ফেরতে কোনো পদক্ষেপ না থাকা, উচ্চ রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণসহ বেশ কিছু বিষয়ে সমালোচনা হয়েছে।
জানতে চাইলে রাজস্ব বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্র ধারা হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের শেষে রাজস্ব আদায়ের পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ভ্যাট ও রাজস্বে প্রবৃদ্ধি ভালো, ডাবল ডিজিটে আছে। অন্যদিকে, ডলার সংকটে আমদানি ও রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এ কারণে কাস্টমসের প্রবৃদ্ধি কিছুট মন্থর।
তার মতে, এবার সরকারের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের তালিকা বেশি বড়। যার মধ্যে রয়েছে সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা। আর তা করতে হলে প্রয়োজন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকানো ও ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে হবে। এ দুটি কাজ করতে পারলে বিনিয়োগের পরিবেশও ইতিবাচক ধারায় ফিরবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, অর্থনীতিতে গতি আনা, রপ্তানিকে ইতিবাচক ধারায় ফেরানো, রিজার্ভ বাড়ানো, আর্থিক খাত স্থিরতায় আনা, মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা, প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি এবং সর্বোপরি রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। আর এসব দিক বিবেচনায় নতুন বাজেটটি হবে সংকোচনমূলক।
আরও জানা গেছে, সম্প্রসারণমূলক বাজেট দেওয়ার পথ থেকে সরে আসতে পারে অর্থ বিভাগ। কেননা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া ঋণের শর্ত মাথায় রেখে রিজার্ভ বাড়ানোর চাপ রয়েছে, পাশাপাশি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আয় সংগ্রহ করার বড় চ্যালেঞ্জও আছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ২৭২ দশমিক ৩৭ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে রাজস্ব আয় বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। বিগত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি আদায় হওয়া খাতগুলোতে এবারও দিতে হবে বাড়তি নজর।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়, সিগারেট থেকে ১১ মাসে তিন হাজার ৫৯২ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় হয়েছে, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ বেশি। এছাড়া ওষুধ থেকে ৪২৪ কোটি টাকা, পেট্রোলিয়াম গ্যাস থেকে ৩১৫ কোটি, বেভারেজ থেকে ১৫৬ কোটি, এমএস রড থেকে ৯৯ কোটি, বিড়ি থেকে ৮১ কোটি, সিরামিক টাইলস থেকে ৮৬ কোটি ও সিমেন্ট থেকে ৬৮ কোটি টাকা আর এলপি গ্যাস থেকে ৪১ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
তামাক প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, মোট অভ্যন্তরীণ আয়ের ১০ শতাংশ আসে তামাক খাত থেকে। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। সম্প্রতি ধূমপান ও তামাকজাতদ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন সংশোধনের দাবি তোলা হয়েছে। সংশোধনীর খসড়াটি বাস্তবায়ন হলে এর প্রভাব পড়বে রাজস্ব খাতে। এছাড়া কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের মতামত খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তাই অধিকতর যাচাই-বাছাই ও অংশীজনের মতামতের জন্য সংশোধনীটি কেবিনেটে ফেরত পাঠানো হয়। দেশের রাজস্ব আদায় যাতে কোনোভাবে বিঘ্নিত না হয় সেটা নিশ্চিত করাটাও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তারা।
২০২৩ সালের শেষে আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। ২০২৪ সালে এসে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মাধ্যমে আমদানি বিল পরিশোধ করেছে। এরমধ্যে রিজার্ভ আরও কমে গেছে। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী রিজার্ভ কমে ২০ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৩৮ কোটি ডলারে নেমেছে।
আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, গত জুন, সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বরে লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। এরপরই নতুন লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয় আইএমএফ। নতুন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আগামী জুনের মধ্যে রিজার্ভ রাখতে হবে ২ হাজার কোটি ডলারের মধ্যে। আইএমএফ গত বছর জানায়, বাংলাদেশকে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে পড়া চাপ মোকাবিলায় খেয়াল রাখতে হবে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেও রাজস্ব আয় পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়। এনবিআরের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ৪৮হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা। সেখানে আহরণ হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। এতে ঘাটতির পরিমাণ ১৬ হাজার ৪৫৯কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজস্ব আদায়ে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে চলতি অর্থবছরটি মোকাবিলা করতে পারে বাংলাদেশ। সে ক্ষেত্রে অর্থনীতির চাকা সচল রাখার কোনো বিকল্প নেই।