মানুষ মরলেই কেন কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙে!

0
22

রাজধানীর বেইলি রোডের যে ভবনটিতে বৃহস্পতিবার রাতে আগুন লেগেছিল, সেই ভবনে ছিল ১৭টি রেস্টুরেন্ট। কিন্তু ভবনের ছিল না অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। সিঁড়ি থাকলেও সেটি ছিল ব্যবসায়ীদের মালপত্রে ঠাসা। ওঠানামার একমাত্র লিফটির সামনে বেশির ভাগ সময়ই ভিড় লেগে থাকে। ভবনটিতে এত রেস্টুরেন্ট বসানোর বৈধতা ছিল না, ফায়ার সার্ভিস তাদের নোটিসও দিয়েছিল, কিন্তু আর কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। এভাবে প্রতি বছরই আগুনে মানুষ হতাহত হওয়ার পর জানা যায় ভবনের অনুমোদন-সংক্রান্ত নানা অনিয়মের কথা। প্রতিবারই প্রশ্ন ওঠে, মানুষ মরলেই কেন কর্তৃপক্ষের ‘ঘুম ভাঙে’। স্বাভাবিক সময়ে এত বড় বড় ভবনে দৃশ্যমান অনিয়মগুলো কেন চোখে পড়ে না? অনেক আগেই অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে থাকা ভবন, কারখানা, বিপণিবিতান, হাসপাতাল চিহ্নিত করেছে ফায়ার সার্ভিস। রাজধানীতে বহুতল ভবন রয়েছে ২ হাজার ৯০০-এর বেশি। এসব ভবনের প্রায় ৯০ শতাংশেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। সে হিসাবে প্রায় ২ হাজার ৭০০ ভবনই অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। কোথাও আগুন লাগলে বা বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি হলেই সবাই সাময়িকভাবে সতর্ক হওয়ার চেষ্টা করি। বাস্তবতা হচ্ছে, ভবন নির্মাণের সময়ে কেউই নিয়মকানুন মানে না। রাজধানীতে যে কোনো স্থাপনা নির্মাণের মূল তদারকির দায়িত্বে রয়েছে রাজউক। এ ক্ষেত্রে রাজউক চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। দেশে নিরাপদ ভবন বা ঝুঁকিমুক্ত অট্টালিকা নির্মাণের জন্য যথোপযুক্ত আইন রয়েছে। ১৯৫২ সালে প্রণীত এই আইনের আওতায় পরবর্তীকালে তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালা। কিন্তু এসব আছে শুধু নথিপত্রে। আইনটি বাস্তবায়নের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এমনকি এসব আইন ও বিধিবিধান বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রের তরফে সমন্বিত কোনো ব্যবস্থা যেমন নেই, তেমনি তদারকির জন্যও নেই কোনো কর্তৃপক্ষ। মূলত এ কারণেই দেশে একের পর এক ভবন ধসের মতো মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকার ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) আওতাধীন এলাকায় ২২ লাখ স্থাপনা রয়েছে। একতলা থেকে ছয়তলার স্থাপনা ২১ লাখ ১২ হাজার আর সাততলা থেকে ২৪-২৫ তলা ভবন আছে ৮৮ হাজার। এর মধ্যে ১০ তলা এবং ১০ তলার বেশি উচ্চতাসম্পন্ন বহুতল ইমারত রয়েছে ২ হাজার ৯০০-এর বেশি। নগরীর বহুতল ভবনের ফায়ার ফাইটিং সিস্টেমের সক্ষমতার ওপর ২০১১ সালে একটি সার্ভে করা হয়। বুয়েট ও ফায়ার সার্ভিস যৌথভাবে এ সার্ভে পরিচালনা করে। সার্ভের সময় রাজধানীর ৫৩টি ভবনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। তাতে দেখা গেছে, নগরীর বহুতল ভবনের ৯০ শতাংশেরই অর্থাৎ প্রায় ২ হাজার ৭০০ ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা সঠিক পাওয়া যায়নি। আমরা ভেবে বিস্মিত হই, রাজউকের অনুমোদন ছাড়া রাজধানীতে বহুতল ভবন তৈরি হতে পারে কীভাবে! আমরা দেখে আসছি, ভবনধস, অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা ঘটলেই কেবল সংশ্লিষ্টরা নড়েচড়ে বসেন। কিছুদিন কর্মতৎপরতা বেড়ে যায়। অথচ রাজধানীকে বাসযোগ্য রাখতে অবৈধভাবে, কোড না মেনে, অনিয়ম করে স্থাপনা নির্মাণ রোধ করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, নির্মাণ প্রকল্প শনাক্ত করে অনিয়মকারীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ভবনের পরিকল্পনা, নকশা প্রণয়ন, স্ট্রাকচারাল ডিজাইন ও নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি ও প্রকৌশলীর দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকরণে প্রয়োজন হলে আইনি সংস্কার করতে হবে।