দারুস সালাম মাসুদের গল্প: সাধ

0
5

প্রতিদিনের ডেস্ক:
অমাবস্যার রাতের মতো কালো মেঘ জমেছে পশ্চিম আকাশে। তীব্র বেগে প্যাঁচিয়ে প্যাঁচিয়ে বইছে কালবৈশাখী হাওয়া। একটি গাছ যেন ঝাঁপিয়ে পড়ছে পাশের আরেকটি গাছের ওপর। ঝরে যাওয়া গাছের পাতাগুলোও ছোটাছুটি করছে দিগ্বিদিক। মুহুর্মুহু চমকাচ্ছে ভীতিপ্রদ বিজলি। এমন সময় বিকট শব্দে বজ্রপাত হয় আঙিনার কোণে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা তালগাছটির ওপর। মুহূর্তে ঝলসে যায় তার জাবড়ানো মাথা। খানিক বাদে বাইরের হাওয়া থামলে বাড়ির উঠোনে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে লোকের সমাগম। মানুষ আসছে ঝলসে যাওয়া গাছটি দেখতে। বজ্রপাতের খবরটি ছড়িয়ে পড়ায় পাশের গ্রাম থেকেও আসছে নারী-পুরুষ। মাজেদ আলী উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়ে আছে গাছটির দিকে। তার নীরব চোখ জানে, প্রকৃতির এরূপ বৈরী আচরণে কিছু বলার নেই। তার মার হাতে লাগানো তালগাছ। বারবার গাছটির আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত অসহায়ের মতো তাকায়। এমন সময় ধপাস করে আম্বিয়ার হাত থেকে তেলের বোতলটা পড়ে গেলে সেই শব্দে ঘুম ভাঙে মাজেদের। এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল সে। চোখ দুটো মেলে দেখে, ভাঙা টিনের ফাঁক দিয়ে পদার্পণ করেছে সকালের সোনালি আলো। এখনো তার পাশে ঘুমাচ্ছে ছয় বছরের আদরের কন্যা পাপিয়া।স্বপ্নের ঘোর কাটাতে হাই তুলতে তুলতে বিছানা থেকে উঠে বসে মাজেদ। দু’হাত দিয়ে একবার আদরও করে কন্যার মায়াময় মুখখানি। মায়া যেন সংগোপনে ছড়িয়ে পড়ে তার অন্তরে। ধীরে ধীরে পা ফেলে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। একটু গলাটা বাঁকা করে দেখে, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা শুরু হয়ে গেছে মাটির ওই বাঁকাপথ দিয়ে। যে পথ দিয়ে সকাল-সকাল বালতি ভরে দুধ নিয়ে যাচ্ছে গণি গোয়াল। বারেক জেলে খাড়িতে নিয়ে ছুটছে বাহারি মাছ। গেরস্থ মাথায় নিয়ে ছুটছে নানা পদের শাক-সবজি। কিন্তু মাজেদ মনে মনে ঠিক করে রেখেছে জাল নিয়ে বের হবে না আজ। মাছ ধরতে যাবে না নদীতে।মাজেদের ছোটো একটি সংসার। এক কন্যা আর স্বামী-স্ত্রী দুজন। পুরো পরিবারটি মায়ায় ভরা। অত্র জেলে পাড়ায় মাজেদ একটু ভিন্ন রকমের মানুষ। পেশায় জেলে হলেও মাঝে মাঝে মাছ ধরা বন্ধ রেখে ডাহুক, ঘুঘু ও বক শিকার করে। মাছ আর নানা জাতের পাখি বিক্রি করে চলে তার প্রীতিকর সংসার। পাখি ধরা তার একটি নেশা। একটি পাখি শিকার করতে কখনো কখনো পুরো দিন কিংবা দুই-তিন দিন সময়ও ব্যয় করে। চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকে নিজের নিশানায়। তবু চোখে-মুখে কোনো ক্লান্তি নেই। এ নেশা ভয়ংকর নেশা। মাঝে মাঝে দুপুরের খাওয়া-নাওয়াও হয় না। তাতেও কোনো দুঃখ নেই। বরং কাজের ফাঁকে ফাঁকে মনের সুখে গুনগুন করে গান গায়। পরিবারের প্রতি মাজেদের প্রেম প্রশংসা করার মতো। গাঁয়ের অন্য জেলেরা যেখানে নিজ স্ত্রীদের মারধর পর্যন্ত করে, সেখানে সে আম্বিয়াকে কোনোদিন একটি কটু কথাও বলেনি। স্ত্রীর প্রতি তার মায়া-মহব্বত, প্রেম, ভালোবাসা অন্যরকম। অভাবের কারণে হয়তো সেটা প্রকাশ পায় না কিন্তু সে সাচ্চা প্রেমিক। বউয়ের জন্য প্রতিদিন ফুল নিয়ে বাড়ি ফেরে। হাসিমুখে গুঁজে দেয় চুলের খোঁপায়। হোক সেটা ঘাসফুল, কলমি ফুল কিংবা কচুরি ফুল। আম্বিয়া মাঝে মাঝেই তারে পাগল বলে। তবে সেটা সোহাগ করে। সে জানে, মাজেদের মতো ভালো লোক আজকাল হয় না। বিয়ের সাত বছর গত হলো। তার মধ্যে কোনোদিন খারাপ কোনো আচরণ দেখেনি। আম্বিয়া তার স্বামীকে নিয়ে বেজায় খুশি।মাজেদ আজ মনে মনে ঠিক করে রেখেছে পাখি ধরতেও যাবে না। বিয়ের সময় আম্বিয়াকে কিছু দিতে না পারার কষ্ট এখনো তাকে নীরবে ভাবায়, কাঁদায়। নিজের কাছে নিজেকে ছোটো লাগে তার। জলিল, আনার, ইসমাইল তাদের বউদের সোনার চেইন দিয়েছে বিয়ের সময়। সে-ই থেকে তারও মনের মধ্যে একটা নীরব সাধ গেঁথে গেছে, আম্বিয়াকে একটি সোনার চেইন দেওয়ার। বুকের ভেতর এটা বহুদিনের শখ। কিন্তু সাত বছর পার হয়ে গেলেও সেই সাধ এখনো পূরণ হয়নি। সোনার দাম দিন দিন বেড়ে যায় বলে মাজেদও পেরে উঠতে পারছে না। কিন্তু তার ইচ্ছার কোনো কমতি নেই। সে টাকা জমাতে জমাতে চার আনা সোনার চেইন কেনার টাকা জমিয়েছে অবশেষে। যদিও আম্বিয়া কোনোদিন তার কাছে সোনার চেইন দাবি করেনি কিংবা কোনোদিন কিছু বলেনি মুখে। তবু মাজেদ তার বউকে একটি সোনার চেইন দিতে চায় স্রেফ ভালোবেসে, প্রেমের টানে। এটা তার হৃদয়ের গভীর আকাঙ্ক্ষা, মনের জমানো সাধ—আম্বিয়াও তা জানে।আম্বিয়া বসে বসে ডেরাঘরে ভাত পাক করছে এখন। মাজেদ একটি বিড়ি নিয়ে যায় চুলার কাছে। মাটির চুলার মিটমিট আগুন থেকে বিড়িটা ধরিয়ে বউয়ের সামনে পিঁড়ি পেতে বসে মুখোমুখি। মনের আনন্দে বিড়ি টানে আর বউয়ের দিকে বারবার তাকায়।অমন করে কী দেখছেন?তোরে দেখছি রে বউ, তোরে দেখছি।সাত বছরেও দেহাদেহি শেষ হয় নাই?না-রে বউ। সাত বছর ক্যান, সাত জনমেও তোরে দেহা শেষ অইবো না। তুই অনেক সুন্দর। রূপসী। তোর চেহারার মধ্যে কী যেন আছে রে! খালি চাইয়া থাকতে মন চায়। জানছ রে বউ—সাড়ে তিন হাত দেহের মধ্যে এই আধহাত চেহারাডাই আসল। মাইনষের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে এই আধহাত জায়গায়। এই আধহাত জায়গার মধ্যে আবার সৌন্দর্য হইলো ঠোঁটে। ঠোঁটের কোণে যে হাসি থাকে ওই হাসি আবার সৌন্দর্য বাড়ায় পুরো মুখখানার। তোর ঠোঁটে হাসি যে লেগেই থাকে। এত অভাবে থেকেও তোর এত হাসি কোথা থেকে আসে রে বউ! আমি তো তোর ঠোঁটের হাসি ভুলতে পারি না।আম্বিয়া এবার হাসি দিয়ে বলে ওঠে—আফনে একটা আস্তা পাগল। আফনের গোষ্ঠীত কি পাগল আছিলনি কেউ?মাজেদ তার কথায় কোনো কর্ণপাত না করে লুঙ্গিখানা হাঁটু পর্যন্ত তুলে ভালো করে বসে এবং বউকে শুনিয়ে শুনিয়ে মিষ্টি করে গায়—‘খায়রুন লো তোর লম্বা মাথার কেশ/ চিরল দাঁতের হাসি দিয়া পাগল করলি দেশ/ খায়রুন লো…’গান শেষ করে মাজেদ প্রেমময় ভঙ্গিতে বলে, তোরে আজ খায়রুন সুন্দরীর মতো লাগতাছে রে বউ! আমি গতকাল দিলুর চায়ের দোকানে বসে টিভিতে খায়রুন সুন্দরী ছবিখান দেখেছি। খুব সুন্দর ছবি। ছবির মধ্যে খালি তোরেই দেখছি। তুই-ই আমার খায়রুন সুন্দরী। তোরে আমি আইজ খায়রুন সুন্দরীর মতো করে সাজাবো। একখান সোনার চেইন তোরে দিতে চাইছি—পারি নাই। সাত বছর পার হয়ে গেল। মনের মধ্যে আফসোস। কিন্তু আইজ তোরে কিন্না দিমুই দিমু! গাঙে জাল নিয়া যামু না। মাছ ধরা বন্ধ। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিতাইগঞ্জ যামু। যাওয়ার আগে তোরে একবার ভালো কইরা দেইখা যাই—কোন ডিজাইন ভালো মানাইবো। আইজ তুই একটু সাজবি। ঘরের ভালো কাপড়ডা পরবি। আমি আইসা তোরে গলায় পরাইয়া দিমু—আমার বহুদিনের আকাঙ্ক্ষার চেইন।আম্বিয়া তারে আর কিছু বলেনি। সোনার চেইন কেন, সে কোনোদিন কিছু চায়নি। যা দিয়েছে তাতেই সে খুশি। আজও চায়নি।অবশেষে খেয়ে-পরে নিতাইগঞ্জের উদ্দেশ্যে মাজেদ বের হয়ে গেলে আম্বিয়া একটু সাজুগুজু করে। ঘরের ভালো কাপড়টা পরে বারবার আয়নার দিকে তাকায়। স্বামীকে খুশি করার জন্যই আজ তার এ সাজ।নিতাইগঞ্জে সোনার দোকানে গিয়ে একটার পর একটা ডিজাইন দেখে মাজেদ। সে চোখ দিয়ে কল্পনা করে কোনটা পরলে আম্বিয়ার গলায় মানাবে, খায়রুন সুন্দরীর মতো লাগবে দেখতে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে তার পছন্দের একটি চেইন কেনে।সকাল পেরিয়ে দুপুর, দুপুর পেরিয়ে বিকেল। সূর্যের তেজ ক্রমশ কমে নরম হয়ে এসেছে আলো। আম্বিয়াও অধীর অপেক্ষায় আছে মাজেদের। স্বামীর হাসি মুখখানা আরও একবার দেখতে চায়। ভালো শাড়ি পরে বারবার ঠিক করে নিজেকে। কেন জানি নিজেকে নিজের কাছে অন্যরকম লাগছে আজ। মনের ভেতর কোনো অস্থিরতা নেই। শান্ত চিত্তেই ঘরে বসে আছে নীরবে। নিজের মুখটা আরেকবার আয়নায় দেখবে বলে ডানহাতটা বাড়াতে চাইলেও আর বাড়াতে পারছে না। কষ্ট হচ্ছে। ডানহাতটা চলে যায় বাম বুকের মধ্যে। বাম বুকে হঠাৎ প্রচণ্ড ব্যথা। অসহনীয়। এরূপ ব্যথা আগেও হয়েছে। তবে আজকের মতো এত তীব্র নয়।আম্বিয়া কিছু বোঝার আগেই ঢলে পড়ে মাটিতে। ‘মা’ বলে পাপিয়া জোরে চিৎকার দিলে প্রথমে ছুটে আসে সোনিয়ার মা। ভালো করে চেয়ে দেখে আম্বিয়া আর নেই। তারপর একে একে শেফালী, ফরিদা, আছমা, মরিয়ম, কুলছুমের মা সবাই আসে। আকস্মিক এই মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই আসে এক নজর দেখতে। লোকের সমাগমে আঙিনা ভরে যায় মুহূর্তে। পাঞ্জাবির পকেটে সোনার চেইন নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির ভেতর ঢোকে মাজেদ। প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনি। তবে পাপিয়ার হাউমাউ কান্না আর বাড়ি ভর্তি লোকজন দেখে বোঝার আর বাকি রইল না।আম্বিয়াকে এক নজর দেখেই স্তব্ধ হয়ে যায় মাজেদ। কোনো রা নেই মুখে। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে ঝরছে অনাকাঙ্ক্ষিত অশ্রু। এ যেন শুধু অশ্রু নয়—ঝরছে মনের শখ, আকাঙ্ক্ষা, সাধ ও সঞ্চিত স্বপ্ন। আম্বিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে ভালো শাড়ি পরে সেজে আছে আজ। তবু মাজেদের দুই ঠোঁট দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। বুকটা ভাঙা কাঁচের আয়নার মতোই হঠাৎ ভেঙে ঝুরঝুরা। কত শখ ছিল মনের ভেতর, নিজহাতে সোনার চেইন পরিয়ে দেখবে আম্বিয়াকে। সাত বছরের সাধ ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল এক নিমিষে। বউয়ের সাজুগুজু মুখটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে মনে মনে বলে, ‘আরেকটু অপেক্ষা করতে পারলি না-রে বউ। সোনার চেইন এখন আমার পকেটে। না খেয়ে ট্যাকা জমাইছি। গত ঈদে তোরে নতুন কাপড় দেই নাই। তোর বুকব্যথার চিকিৎসা করাইতে পারি নাই। গরিব মানুষ তার সাধ পূরণ করতে গিয়া ট্যাকা জমায় না খাইয়া, না পইরা, চিকিৎসা না কইরা! আসলে গরিবের কোনো সাধ থাকা উচিত না-রে বউ!’