উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিদ্যুৎ নেই, জেনারেটর চলে না, প্রচণ্ড তাপদাহে রোগিরা ভোগান্তিতে

0
18

উৎপল মণ্ডল,শ্যামনগর
ঘড়ির কাটা রাত ১০টা বেজে সাত মিনিট। শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্ষের জরুরী বিভাগে যেয়ে দেখা যায় দেয়ালে লাগানো একমাত্র এলইডি লাইট-এ ভরসা। সেই আলোতে ভর করে জরুরী বিভাগে কর্মরত মেডিকেল ও সহকারী মেডিকেল অফিসারসহ আরও দু’তিনজন স্বেচ্ছাসেবক আগত রোগীদের সেবা দিচ্ছেন। বিদ্যুৎ না থাকায় গরমের প্রচন্ডতায় চিকিৎসা কাজে নিয়োজিতদের পাশাপাশি আগত রোগী আর তাদের স্বজনদের অবস্থা বেশ কাহিল। মিনিট পনের পার হতেই শ্বাষকষ্টে ভুগতে থাকা সাত মাসের এক শিশু কন্যাকে নিয়ে জরুরী বিভাগে হাজির হয় আলিমুজ্জামান নামের এক অভিভাবক। তবে বিদ্যুৎ না থাকায় দীর্ঘক্ষন পর্যন্ত তাকে অক্সিজেন কন্সেন্টেটর সহায়তা দেয়া সম্ভব হলো না। এসময় কয়েকজন রোগীদের শুশ্রƒষায় নিয়োজিত ঘর্মাক্ত চিকিৎসকদের শরীরে হাতপাখার বাতাস দিতে দেখা যায় আরও কয়েক রোগীর স্বজন আর স্বেচ্ছাসেবকদের। কিছুক্ষন বাদে প্রায় ৩০/৩৫ গজ হেঁটে পুরুষ ওয়ার্ডে পৌছে দেখা মেলে আরও করুণ চিত্রের। বিদ্যুৎবিহীন ঘুটঘুটে অন্ধকার কক্ষের মধ্যে মোবাইলের আলো জেলে অসহায়ত্বের মত মেঝেতে পড়ে রয়েছেন চিকিৎসাধীন রোগীরা। ‘বেডে গরম বেশী দাবি’ করে এসব রোগী জানায় ছয়টি বেড থাকলেও সেখানকার দুটি ফ্যানের একটি অকেজো। তাছাড়া বিদ্যুৎ না থাকায় দিনের বেশিরভাগ সময় ঘুরছে না অপরটি। বাধ্য হয়ে তারা কক্ষের মেঝেতে বালিশ পেতে অতিকষ্টে সময় কাটাচ্ছেন। পুরুষ ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে নারী ওয়ার্ডে যাওয়ার আগমুহুর্তে বারান্দায় বিশ্রামরত ধুমধাট গ্রামের গনেশ মন্ডল জানান, ‘বাপু এ যেন সরকারি হাসপাতাল না, অন্ধকার কোন নগরী। না একটা লাইট, না ফ্যান।” ঘরের মধ্যে জায়গা না হওয়াতে বারান্দায় শুয়ে বসে চিকিৎসা নেয়া এসব রোগীদের দাবি দীর্ঘক্ষন বিদ্যুৎ না থাকায় তারা রীতিমত ভুতুড়ে পরিবেশে অবস্থান করছেন। হাসপাতাল কতৃপক্ষ জেনারেটর ব্যবহার না করায় বিদ্যুৎহীন প্রতিটি দিনই এমন বলে দাবি করেন বারান্দায় অবস্থান নিয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর । জাহাঙ্গীরের পাশ অবস্থানরত কয়েক রোগী জানায় সরকারি হাসপাতালে জেনারেটর রয়েছে। তবুও তীব্র এ গরমে গোটা হাসপাতালজুড়ে চিকিৎসাধীন রোগীদের জন্য এক মিনিটও জেনারেটর সুবিধা দেয়া হচ্ছে না। প্রচন্ড গরমে রোগীদের ভোগান্তি বাড়লেও কর্তৃপক্ষ তাতে গুরুত্ব দিচ্ছে না।এদিকে নারী ওয়ার্ডে উঁকি মারতেই দেখা দেলে পাঁচ বেডের ছোট কক্ষে একটি ফ্যান। তবে বিদ্যুৎ না থাকায় ’নড়চড়’ নেই সে যন্ত্রের। ক্লান্ত শরীরে অঘোরে ঘুমাতে থাকা আমিরণ বিবি জেগে উঠে বলেন, তোমরা এটটা লাইট আর ফ্যানের এটটু ব্যবস্থা করে দেও। তিনি আরও বলেন, সুস্থ হতি এসে যে আমরা আরও অসুস্থ হয়ে গেলাম। গরমে সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছি, তবুও দেখার কেউ নি। ঘোরাঘুরির শেষ পর্যায়ে রাত ১১টার দিকে শিশু ওয়ার্ডে যেয়ে দেখা মেলে চরম অমানবিক আর অবর্ণনীয় আরও এক দৃশ্যের। মাত্র সাত বেডের শিশু ওয়ার্ডে রোগী আর স্বজন মিলে ততক্ষনে ২২জনের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। প্রচন্ড গরমের মধ্যে ঠাসাঠাসি করে কোন বেডে তো রীতিমত তিনজনকে আবিস্কার করা হয়। শুধুমাত্র প্রবেশদ্বার ছাড়া বর্গাকৃতির ঐ শিশু ওয়ার্ডে বাতাস বাহির হওয়ার মত ন্যুনতম কোন ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা নেই। উত্তর প্রান্তে বড় একটি জায়গাজুড়ে লোহার গ্রিলের খঁাচা থাকলেও সেই অংশের পুরোটাই আবার গ্লাসে মোড়ানো। বাকি দু’পাশ ইট পাথরের দেয়ালে আটকানো। বাধ্য হয়ে তীব্র গরমে রীতিমত কাহিল অবস্থা চিকিৎসা নিতে আসা প্রায় প্রতিটি শিশুর। অগত্যা প্রায় দেড় ঘন্টা বিরতি দিয়ে ‘বহু প্রতিক্ষিত’ বিদ্যুতের আগমন ঘটলেও দুই প্রান্তে থাকা দু’টি পাখা কেবলই ‘ধিক’ ‘ধিক’ করে ঘুরছে। বিদ্যুৎ এলেও অচল পাখার জারিজুরিতে কাজ না হওয়ায় বাধ্য হয়ে স্বজনরা নিজ উদ্যাগে নিয়ে আসা টেবিল ফ্যান আর হাত পাখাসহ গামছার বাতাসে কোন রকমে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে।
এমন অবস্থার দেখা মেলে ২৮ এপ্রিল রোববার রাত পৌণে দশটা থেকে সাড়ে এগারটা পর্যন্ত সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিভিন্ন ওয়ার্ড ও জরুরী বিভাগে। রোগী, তাদের স্বজন ও হাসপাতাল কতৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানা যায় বিদ্যুৎ এর অব্যাহত লোডশেডিং এর মারাত্বক প্রভাব পড়ছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তবে এ চিত্র কেবল এক দিনের নয়। বরং গরমের প্রচন্ডতা শুরুর পর থেকে এটা নিত্যকার ঘটনায় পরিনত হয়েছে। জানা যায় ‘ডাবল ফিডার’ বা বিকল্প লাইন না থাকার দরুন ঐ এলাকায় লোডশেডিং শুরু হলে গুরুতর অসংখ্য রোগী থাকা সত্ত্বেও উপজেলার ৫০ শয্যা হাসপাতালটি দীর্ঘক্ষন পর্যন্ত থাকে বিদি্যুৎ বিচ্ছিন্ন। এসময় তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের অক্সিজেন কন্সেন্টেটর সাপোর্ট পর্যন্ত দেয়া সম্ভব হয় না। এমনকি চিকিৎসা সেবা নিতে আসা অংসংখ্য রোগী গরমের তীব্রতায় সরকারি হাসপাতালে এসে বরং আরও বেশী অসুস্থ হয়ে পড়েন। রোগীদের অভিযোগ ওয়ার্ড ও কেবিনগুলোর ফ্যানসমুহ বেশিরভাগ পুরানো এবং নষ্ট থাকার অনেক সময় বিদ্যুৎ থাকলেও তা কোন কাজে আসে না। বার বার এসব বিষয়ে কতৃপক্ষকে অবহিত করেও কোন প্রতিকার মিলছে না বলেও অভিযোগ তাদের। কাশিপুর গ্রাম থেকে ডায়ারিয়া আক্রান্ত শিশুকে নিয়ে আসা শাহরিয়ার হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ না থাকায় খুব সমস্যা হচ্ছে। মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎ এলেও ফ্যান নষ্ট বিধায় সে বাতাস শরীরে লাগছে না। সন্তানকে সুস্থ করতে এনে আরও অসুস্থ বানিয়েছেন বলেও ক্ষোভ ঝাড়েন করেন তিনি। নুরনগর গ্রামের শওকাত আালী বলেন, তিন দিন আগে ভর্তি করেছি মেয়েকে। বেশিরভাব সময় বিদ্যৎ না থাকায় রীতিমত সিদ্ধ হতি হচ্ছে। মাঝেমধ্যি বাইরে যেয়ে বসে থাকতি হচ্ছে- জানিয়ে তিনি আরও বলেন এত বড় হাসপাতালে একটা জেনারেটর পর্যন্ত নেই। ‘বাড়ি গেলে বিনা চিকিৎসা মরতে হবে, এখানে এসে ছেগস্থ (ভোগান্তী) পোহাতি হচ্ছে’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।রোগী এবং স্বজনদের অভিযোগ ফ্যান নষ্টের বিষয়ে অভিযোগ করলে তাদেরকে বার বার মিস্ত্রি আসার আশ্বাষ দেয়া হয়। কিন্তু দিনের পর রাত পার হলেও কোন মিস্ত্রির দেখা মেলে না। এমনকি জেনারেটর সুবিধা দিয়ে রোগীদের দুর্দশা লাঘবেও তারা আন্তরিক না বলেও এসব রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ। অনুসন্ধান জানা যায় প্রায় ১৫ বছর আগে সরকারিভাবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জন্য ১০ কিলো ওয়ার্ট ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর বরাদ্দ দেয়া হয়। দীর্ঘদিন সেই জেনারেটরে বিভিন্ন ওয়ার্ড, কেবিন বা প্রশাসনিক ভবনের বিদ্যুৎ চাহিদা পুরণ হলেও গত কয়েক বছর ধরে তা কেবলই জরুরী অপারেশনের কাজে ব্যবহৃত হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কয়েকজন কর্মচারী জানান ১০ কিলো ওয়াট ক্ষমতার ঐ জেনারেটর চালু করতে প্রতি ঘন্টায় মাত্র দুই লিটারেরও সামান্য কিছু বেশী ডিজেলের প্রয়োজন পড়ে। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন উক্ত জেনারেটর ব্যবহার করে একইসাথে ওয়ার্ড ও কেবিনসহ জরুরী বিভাগের কাজ মেটানো সম্ভব। তবুও খরচ সাশ্রয়ের জন্য মুলত উক্ত জেনারেটরের সুবিধা বঞ্চিত রাখা হচ্ছে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা শত শত রোগীকে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ জিয়াউর রহমান বলেন পরিত্যক্ত ঘোষিত মুল ভবনের সাথে জেনারেটর সেট করা। বিধায় সেটাকে নুতনভাবে স্থাপন করার মত জায়গা যেমন নেই তেমনী তার রক্ষনাবেক্ষন ও ব্যবহার বেশ ব্যয়বহুল্য। জরুরী কিছু অপারেশনের সময় উক্ত জেনারেটর চালানো হয় না। তিনি আরও বলেন পল্লী বিদ্যুৎ কতৃপক্ষের কাছে বার বার ধরনা দিলেও সরকারি হাসপাতালের জন্য ডাবল ফিডারের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না।